সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে এডিপির এক-তৃতীয়াংশ বাস্তবায়ন হয়নি

এফএনএস এক্সক্লুসিভ | প্রকাশ: ২৬ জুলাই, ২০২৫, ০৮:১০ এএম
সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে এডিপির এক-তৃতীয়াংশ বাস্তবায়ন হয়নি

দেশের ইতিহাসে বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সর্বনিম্ন পর্যায়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার। মূলত দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ নানা কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে  এড়ানো সম্ভব হয়নি সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়নের রেকর্ড। অযাচিত অর্থ খরচে সরকারের কঠোরতায় এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং পর্যাপ্ত অর্থছাড় না হওয়ার কারণে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন হার ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। ফলে সদ্যবিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপির এক-তৃতীয়ংশ বাস্তবায়ন হয়নি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বরাদ্দের হিসাবে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাদে বেশিরভাগই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে ১ হাজার ৪৬৮টি প্রকল্প ছিল। সংশোধিত বাজেটে উন্নয়ন খাতে খরচের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে ৫৮ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা ওসব প্রকল্পের বিপরীতে মাত্র ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা খরচ হয়, যা বরাদ্দের ৬৭.৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপির এক-তৃতীয়ংশ বাস্তবায়ন হয়নি।

সূত্র জানায়, বিদেশি ঋুনির্ভর প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে গত অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে ৮১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে মাত্র ৫৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অর্থাৎ বরাদ্দের মোট ৬৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ সরকার খরচ করতে সক্ষম হয়েছে। যা এদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। অথচ করোনার সময়েও ৯২ শতাংশের বেশি বিদেশি ঋণের প্রকল্পে খরচ করা হয়েছিল। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আগে কখনো এত কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল। কারোনাকালীন ওই অর্থবছরেও ৮০.৩৯ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল। করোনার সময় বেশিরভাগ উন্নয়নকাজ বন্ধ থাকলেও ওই বছর বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্পের হার গত অর্থবছরের চেয়েও সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। এমনকি এর আগে কোনো অর্থবছরেই ৮০ শতাংশের নিচে এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ বেশিরভাগ অর্থবছরেই ৯০ শতাংশের ওপরে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সর্বোচ্চ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল। ওই বছর ৯৪.৬৬ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাস্তবায়ন হার ছিল ৯৪.০২ শতাংশ, ২০১১-১২ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছিল ৯৩ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯২.৭২ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯২.৭৪ শতাংশ এবং ২০০৪-০৫ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে ছিল ৯২ শতাংশ। তাছাড়া ২০০৫-০৬, ২০০৯-১০, ২০১২-১৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৯১ শতাংশ, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ছিল ৮৩ শতাংশ, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৮২ শতাংশ, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৮৬ শতাংশ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮৯.৭৬ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮২.১১ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৫.১৭ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৮০.৯২ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়ন হারের সঙ্গে মাসের হিসাবেও চলতি অর্থবছরেও শেষ মাসে কম খরচ হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুনে এডিপি বাস্তবায়নে ৪২ হাজার ৪৪৫ কোটি ১০ লাখ টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ ওই সময় বাস্তবায়নের হার ১৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অথচ এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে খরচ হয় ৫৮ হাজার ৭৪২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের ২৩ দশমিক ০৯ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের হিসাবেও গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বাস্তবায়ন হার কম।

সূত্র আরো জানায়, সরকারের সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বরাদ্দের অর্ধেকও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তার মধ্যে স্বাস্থ্য খাত সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। আর স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। ওই বিভাগটির এডিপি বাস্তবায়ন হার ১৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। আর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বাস্তবায়ন করেছে বরাদ্দের মাত্র ২১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। তাছাড়া প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের বাস্তবায়ন হার ৪২ দশমিক ০৫, জননিরাপত্তা বিভাগের ৩৯ দশমিক ৫৫, ভূমি মন্ত্রণালয় ৩৭ দশমিক ৪৬, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ৩২ দশমিক ০২ এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের বাস্তবায়ন হার ৩৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তবে এডিপি বাস্তবায়নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবচেয়ে এগিয়ে আছে। তারা বরাদ্দের ৯৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। তাছাড়া, বিদ্যুৎ বিভাগ বরাদ্দের ৯৮ দশমিক ১০ শতাংশ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৯৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ ৯৮ শতাংশ, কৃষি মন্ত্রণালয় ৯১ দশমিক ০৭ শতাংশ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ৯১ দশমিক ৫৮ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। আর এডিপি বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগ সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে। ওই বিভাগটির জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা, অর্থবছর শেষে তারা খরচ করেছে ৩০ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৮৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।

এদিকে এডিপি বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বড় ধাক্কা লাগে। ফলে ধীরগতি দেখা দেয় উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে। আর তাতেই এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এডিপি বাস্তবায়ন না হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির পাশাপাশি অর্থের অপচয় হয় এবং সুফল পাওয়া যায় না। এডিপি বাস্তবায়ন হার বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। সেজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা বাড়ানো এবং সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি।

অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে আইএমইডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, অন্যান্য অর্থবছরগুলোর তুলনায় এবার এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে। তবে অন্য অর্থবছরগুলোর সঙ্গে এর তুলনা করলে হবে না। গত অর্থবছর একটা ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল। মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাবে এমনটি হয়েছে। গত অর্থবছরের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অযাচিত অর্থ খরচে কঠোর হয়। যে কারণে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দেয়ার নেতিবাচক প্রভাব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পড়ে। আর ওসব কারণে বাস্তবায়ন হয়েছে কম এডিপি।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে