মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় প্রমত্তা পদ্মা নদীর প্রবল স্রোতের কারনে ভাঙ্গন আতংকে দিন যাপন করছেন নদীর তীরবর্তী এলাকার জনসাধারণ। চলমান বৈরী আবহাওয়ায় শুক্রবার সকাল থেকে বৃষ্টি, প্রচন্ড বাতাস আর প্রবল স্রোতের কারণে লৌহজংয়ের পদ্মাপাড়ের কয়েকটি এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে উপজেলার সিংহেরহাটি ও বড়নওপাড়া এলাকায় পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে ফেলে রাখা বালুভর্তি জিও ব্যাগ সরে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় মাটি সরে গিয়ে ফাটল দেখা দিয়েছে। এদিন বিকালে প্রবল স্রোত ও উঁচু উঁচু ঢেউয়ের আঘাতে ভাঙনের মাত্রা বেড়েছে সকালের চেয়ে দ্বিগুণ। এতে পদ্মাপাড়ের মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
ভাঙনের খবর পেয়ে লৌহজং উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নেছার উদ্দিন শুক্রবার বিকালে ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করে স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, নদী তীরের বসিন্দাদের কেউ কেউ স্বজনদের নিয়ে পানিতে নেমে বাঁশ, কচুরিপানা, খড়কুটো দিয়ে নদীর ভাঙন থেকে বাড়িঘর রক্ষার চেষ্টা করছেন। তারা জানান, শুক্রবার সকাল থেকেই পদ্মার ভাঙনে জিও ব্যাগ সরে যাচ্ছে, এর ফলে মাটি সরে গিয়ে অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। কনকসার-নাহেরহাট খালের উৎসমুখ পদ্মাপাড়ে। অনেকের বাড়ির পাড় থেকে ব্লক ফেলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সেসকল বাড়ি থেকে পশ্চিমে প্রায় ৫০০ মিটার এলাকা স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের বাইরে রয়েছে। যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে, তার কোন ব্যাবস্থা না নেওয়া হলে কয়েকদিনের মধ্যেই বড় ধরনের ভাঙ্গনের আশংকা করছেন এলাকাবাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মানদীর ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে পদ্মা সেতুর ভাটিতে বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৪৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া থেকে টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দীঘিরপাড় পর্যন্ত পদ্মা নদীর ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ কিলোমিটার তীর এলাকায় চলছে স্থায়ী ও সতর্কতামূলক বাঁধ নির্মাণের কাজ। এর মধ্যে স্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজ ৯ দশমিক ১০০ কিলোমিটার এবং সতর্কতামূলক প্রতিরক্ষা কাজ (ভাঙনপ্রবণ এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ রাখা স্থান) ৪ দশমিক ৬২০ কিলোমিটার। ২০২১ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের অক্টোবরে। তখন ৯ দশমিক ১ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। অর্থ বরাদ্দ ছিল ৪৪৬ কোটি টাকা। পরে বাঁধ নির্মাণের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে করা হয় ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ কিলোমিটার। আর ৪৪৬ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে অর্থ বরাদ্দ করা হয় ৪৭০ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে পুনরায় বরাদ্দ বাড়িয়ে ৫২৭ কোটি টাকা করা হয়। সেই সাথে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বর। বর্ষা মৌসুমের আগে বাঁধ নির্মাণের কাজ ধীর গতিতে শঙ্কিত পদ্মাপাড়ের বাসিন্দারা। আড়াই দশকে দুই উপজেলার প্রায় ৪০টি গ্রাম বিলীন হয়েছে। ভিটেমাটি, জমিজমা হারিয়েছেন অর্ধ লক্ষ পরিবার।
মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি প্রায় ৪৮ শতাংশ। ২৬টি প্যাকেজের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী এনামুল হক জানান, প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৮৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা কাজ ৯ দশমিক ১০০ কিলোমিটার এবং সতর্কতামূলক প্রতিরক্ষা কাজ (ভাঙনপ্রবণ এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ রাখা স্থান) ৪ দশমিক ৬২০ কিলোমিটার। এছাড়া ১ দশমিক ৩০০ কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ী বাঁধ বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প বহির্ভূত এলাকা রয়েছে ১ দশমিক ৮৫০ কিলোমিটার। কনকসার খালের মুখে পদ্মাতীরের বাসিন্দারা জানান, আমাদের বাড়ি থেকে পশ্চিমে ৫০০ মিটার এলাকা স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বাইরে, তাই শঙ্কায় আছি। গত বছর ঢেউয়ের আঘাতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হলে নিশ্চিন্ত হতাম। এ বিষয়ে উপসহকারী প্রকৌশলী এনামুল হক বলেন, স্থায়ী বাঁধে কিংবা সতর্কতামূলক স্থানে ভাঙন দেখা দিলে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ভাঙনপ্রবণ এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে লৌহজং উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নেছার উদ্দিন বলেন, আপনাদের সহযোগিতা ও ধৈর্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। ভাঙন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সকল প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে চলমান রয়েছে। তীব্র স্রোতের কারণে নদীতে স্থাপিত কয়েকটি স্থানের কিছু জিও ব্যাগগুলো সরে যাওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে ভাঙ্গন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গতকাল তথ্য পাওয়ার সাথে সাথেই সরেজমিনে ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে।
স্থানীয় এলাকাবাসীদের ভাঙন প্রতিরোধে অতিদ্রুত সময়ে মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।
তিনি জানান, ভাঙন আতঙ্ক নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়ছে, যেমন-
জিও ব্যাগ পুনঃস্থাপনের কাজ তাৎক্ষণিকভাবে শুরু করা হয়েছে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক অতিরিক্ত জিও ব্যাগ ও জনবল ইতিমধ্যে মোতায়েন করা হয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয়দের সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ চলমান রয়েছে, ভাঙন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সকল প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে চলমান রয়েছে।