রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ১৫ টি ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি কওমী মাদ্রাসায় ভুয়া এতিম অনাথ তালিকাভুক্তির মাধ্যমে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মোহতামিম। সরেজমিন যাচাই করে দেখা গেছে,এসব মাদ্রাসায় আবাসিক /অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা রীতিমতো প্রতিমাসে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত বেতন ভাতা পরিশোধ করে থাকেন। অথচ এদের অনেকের নাম এতিম/অনাথ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা ছাড়াও ভুয়া কিছু নাম তালিকাভুক্তির মাধ্যমে ক্যাপিটেন গ্রান্ডের বরাদ্দকৃত অর্থ উত্তোলন করা হচ্ছে। অনেক স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের মোটা অংক ব্যয় করে এসব মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেয়। আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে প্রতিমাসে কর্তৃপক্ষের দাবিকৃত অর্থ পরিশোধও করেন অভিভাবকরা। এসব অভিভাবক জানেনই না যে তাদের সন্তানের নাম এতিম হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং প্রতিমাসে নিয়মিত ক্যাপিটেন গ্রান্ডের অর্থ উত্তোলন করা হয়। উত্তোলনকৃত অর্থ মাদ্রাসার উন্নয়নে ব্যয় করে সিংহভাগই মোহতামিমরা নিজেদের পকেট ভারি করেন। ওই টাকায় গাড়ি বাড়ি হয়। কোন কোন মাদ্রাসায় মোহতামিমের কক্ষে এসি চালু রয়েছে। অনেকেই প্রতি বছর মোটর বাইকের মডেলও পাল্টান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,অনেকগুলো মাদ্রাসায় যে সংখ্যক শিক্ষার্থীর নামে ক্যাপিটেন গ্রান্ড বরাদ্দ রয়েছে ওই সংখ্যক শিক্ষার্থীই নেই গোটা মাদ্রাসায়। টুকুরিয়া ইউনিয়নের তরফমৌজা মহিলা এতিমখানায় মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ জন হলেও ৬০ জনের নামে প্রতিমাসে বরাদ্দ রয়েছে। মোনাইল মেফতাউল উলুম এতিম খানায় ৬/৭ জন শিক্ষার্থীকে বিনা বেতনে আবাসিক হিসেবে রাখা হলেও ৫০ জন এর নামে বরাদ্দকৃত অর্থ উত্তোলন করা হয় প্রতিমাসে। উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ধনশালা গ্রামে রাবেয়া বসরী বালিকা এতিমখানায় মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে ১০ থেকে ১৫ জন, সেস্থলে ৩৫ জন শিক্ষার্থীর নামে টাকা উত্তোলন করা হয় প্রতিমাসে। মদনখালী ইউনিয়নের জাফরপাড়া এতিমখানায় শিক্ষার্থীরা বেতন ভাতা দিয়ে পড়া লেখা করলেও ৩৫ জনের নামে বরাদ্দকৃত অর্থ উত্তোলন করা হয়। চৈত্রকোল জিল্লুরনাইন এতিমখানায় মোট ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থীর সংখ্যা হলেও ৬৭ জনের নামে বরাদ্দ রয়েছে। মিঠিপুর ইউনিয়নে কাশিমপুর দারুল আমান সিদ্দিকিয়া এতিমখানায় ৮৭ জন,মাদারগঞ্জ সিদ্দিকিয়া এতিমখানায় ২০ জন,সদরা কুতুবপুর আমিনিয়া এতিমখানায় ২০ জন, কাবিলপুর ইউনিয়নে মানাসী ফরিদপুর শিশু সদন ও এতিমখানায় ৮০ জন,ইসলামীয়া শিশু সদন ধাপেরহাট বিষ্ণপুর এ ৩০ জন,চতরা শিশু সদন এ ৪৫ জন, বাবনপুর দারুস সালাম এতিমখানায় ৫০ জন,গোপীনাথপুর মফিজিয়া অজিতন নেছা এতিমখানায় ১’শ ২০ জন, খায়রুন্নেছা মহিলা এতিমখানা ও শিশু সদন বাঁশপুকুরিয়ায় ৮ থেকে ১০ জন শিক্ষার্থী থাকলেও ২০ জনের নামে অর্থ উত্তোলন করা হয়। কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী উপজেয়ায় ২৪ টি মাদ্রাসায় ১ হাজার ৬’শ ৯৭ জন এতিমের নামে প্রতিমাসে ৩৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। মজার ব্যাপারে হচ্ছে-এসব মাদ্রাসার মোহতামিমরা প্রতিবছর বিপুল পরিমান বরাদ্দকৃত অর্থ উত্তোলন করলেও তা এলাকায় প্রকাশ করতে রাজি নন। যে কারনে এসব মাদ্রাসার কোনটিতেই ক্যাপিটেন গ্রান্ডের সাইনবোর্ড পর্যন্ত দেয়া হয়নি। অথচ শিক্ষার্থীর সংখ্যা,বরাদ্দের পরিমান,প্রতিদিনের খাদ্য তালিকাসহ যাবতীয় তথ্য সংক্রান্ত সাইনবোর্ড টানানোর নির্দেশ রয়েছে। উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক এসব দেখাশোনার দায়িত্বে থাকলেও তিনি রহস্যজনক কারনে বরাবর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেন। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য হলো-“এসব সমাজ সেবা মন্ত্রনালয়ের ব্যাপারে। তারা এগুলো বরাদ্দ দেয়”। দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নিজেদের অবস্থানকে মজবুত করতে এ বছর মোহতামিমরা ৭ সদস্যের একটি কমিটি করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মোহতামিম জানান,কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম ও সম্পাদক মনজুরুল হক বিভিন্ন ঝুটঝামেলা মেটানোর নামে সবগুলো মাদ্রাসা থেকে প্রত্যেক এতিম/অনাথ এর অনুকলে ৮০ টাকা হারে মোট ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭’শ ৬০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। হাতিয়ে নেয়া এই টাকা কোন খাতে ব্যয় করেছেন ? তা বলতে রাজি হননি কমিটির লোকজন। এলাকার সচেতন অভিভাবক মহল তাই অচিরেই প্রত্যেক মাদ্রাসায় ক্যাপিটেন গ্রান্ড প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা সম্বলিত সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়ার দাবি করেছেন। উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সরেজমিন তদন্ত করা হলে এসব মাদ্রাসায় ক্যাপিটেন গ্রান্ডের অর্থ তছরুপের আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে একাধিক নির্ভর যোগ্য সুত্র জানিয়েছে।