বিক্রেতারা হতাশ, ক্রেতারা খুশি

দিনাজপুরে ধান ও চালের বাজারে মূল্য হ্রাস

এফএনএস (জি.এম.হিরু; দিনাজপুর) : | প্রকাশ: ২৮ জুলাই, ২০২৫, ০৫:১৮ পিএম
দিনাজপুরে ধান ও চালের বাজারে মূল্য হ্রাস

উত্তরাঞ্চলে শীর্ষ ধান ও চাল উৎপাদনকারী জেলা দিনাজপুরে হঠাৎ করে ধানের বাজারে ধ্বস নেমেছে। আর এর প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দিনাজপুরের পাইকারী চালের দাম ৫০ কেজির বস্তায় কমেছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। মিলাররা বলছেন- বাজারে ধানের দাম কমে যাওয়ায় চালের মূল্য কমছে। আর বাইরে থেকে চাল আমদানী ও আগষ্ট মাস থেকে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচী চালুর প্রভাব ধান ও চালের বাজারে পড়েছে বলে জানান খাদ্য কর্মকর্তা। 

এদিকে চালের বাজারে দাম কমলেও ক্রেতা সংকটে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা জানান- এক সপ্তাহ ধরে চালের বাজারে ক্রেতা সংকট রয়েছে। 

রোববার সকালে দিনাজপুর শহরের সবচেয়ে বড় চালের পাইকারী বাজার বাহাদুর বাজার (এনএ মার্কেট) ঘুরে দেখা যায়, এক সপ্তাহ আগে এই বাজারে ৫০ কেজির বস্তা জিরাশাইল ৩,৫৫০ টাকা বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩,৪০০ টাকায়, বিআর ২৮ জাতের চাল ৫০ কেজির বস্তা ৩,১৫০ টাকার হতে বর্তমানে ২,৯৫০ টাকায়, বিআর ২৯ জাতের চাল ৫০ কেজির বস্তা ২,৯০০ টাকার ২,৮০০ টাকায়, সুমন স্বর্ণ জাতের চাল ৫০ কেজির বস্তা ২,৮৫০ টাকার চাল ২,৮০০ টাকায়, সুমন স্বর্ণ জাতের চাল ৫০ কেজির বস্তা ২,৬৫০ টাকার চাল ২,৫০০ টাকায়, বাশমতি চাল ২৫ কেজির বস্তা ২,২৩০ টাকার চাল ২,২০০ টাকায়, সিদ্ধ সম্পা চাল ২৫ কেজির বস্তা এক সপ্তাহ পূর্বে ১,৮২০ টাকা বিক্রি হলেও বর্তমানে ১,৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। 


বাজারে চালের দাম কমায় খুশি দিনাজপুরের শ্রমজীবী-সাধারণ মানুষেরা। তবে ক্রেতা সংকটে ভুগছেন চাল ব্যবসায়ীরা। দিনের অধিকাংশ সময় অলস সময় পার করছেন তারা। 


চাল কিনতে আসা অটো চালক ফরহাদ বলেন, “এক সপ্তাহ পূর্বে বাজারের চালের দামের তুলনায় আজ কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা কম পাচ্ছি। সারাদিন ইজিবাইক চালিয়ে পরিবারে চালাতে হয়। এক কেজি চালে ৩ টাকা বেচে গেলেও সেটা আমাদের কাছে অনেক। প্রতিদিন বাসায় ২ থেকে আড়াই কেজি চাল লাগে। চালের বাজার যেন সামনে আরও কমে এই দোয়া করি।” 


শহরের পাটুয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা রুবিনা বলেন, “কয়েকদিন আগে বাজারের চালের দাম ১০ টাকা পর্যন্ত কেজিতে বেড়েছে। এখন ২ থেকে ৩ টাকা কমলো। আমাদের দেশে কোন জিনিসের দাম এক বার যেভাবে বাড়ে, সেই জিনিসের দাম সেভাবে কমে না। তবে সরকারের কাছে অনুরোধ চালের দামটা যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। নইলে আমরা গরীব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে আমরা কোথায় যাব।”


সুফী রাইস এজেন্সির সত্বাধিকারী জাহিদ কামাল জাভেদ বলেন, গেল কয়েকদিন ধরেই চালের দাম কমছে। মিলা গেটে দাম কম হওয়ায় আমরা কম দামে চাল বিক্রি করতে পারছি। কিন্তু কয়েকদিন ধরে চালের দাম কমলেও বাজারে ক্রেতা নেই। আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাত্র ১ জন ক্রেতা আসলো। এখন এক বস্তা চাল বিক্রি হলো। অথচ দাম যখন বেশি থাকে, তখন ক্রেতা অনেক আসে। দাম কমলে ক্রেতা আর আসে না। 


‘খাদ্য ভান্ডার’ এর স্বত্বাধিকারী আলাল হোসেন বলেন, “বাজারে ধানের দাম কম হওয়ায় মিলাররা কম দামে চাল আমাদের দিচ্ছে। আমরা কম দামে চাল বিক্রি করছি। এক সপ্তাহ থেকে চালের বাজারে ক্রেতাদের সে রকম আনাগোনা নাই। আমরা এখন দিনের অধিকাংশ সময় অলস সময় পার করছি।”


সোমবার সকালে দিনাজপুর শহরের গোপালগঞ্জ বাজারের ধান হাট ঘুরে সরেজমিনে গেছে, এই বাজারে বিআর ২৮ জাতের ধান ১৪০০ টাকা মন, বিআর ২৯ জাতের ধান ১৩০০ টাকা মন, ৮৮ জাতের ধান ১৩৫০ টাকা মন ও বগুড়া কাঠারী জাতের ধান ১৬৫০ টাকা দরে প্রতি মন বিক্রি হচ্ছে। যা বৃহস্পতিবার ২৮ জাতের ধান ১৪৪০ টাকা, ২৯ জাতের ধান ১৩৫০ টাকা, ৮৮ জাতের ধান ১৪০০ ও বগুড়া কাঠারী জাতের ধান ১৭৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। 


জেলার বীরগঞ্জ উপজেলা থেকে এই বাজারে ধান বিক্রি করতে আসা নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ধান ব্যবসায়ী এ প্রতিনিধিকে জানান, “মৌসুমের শুরুতে ধান মজুদ করেছিলাম। গত সপ্তাহেও কিছু ধান বিক্রি করেছি। সেই সময় দাম কিছুটা ভালো পাইছি। কিন্তু সরকার বাইরে থেকে চাল আমদানীর ঘোষণা দিয়েছেন। এই কারণে কয়েকজন মিলারের সাথে কথা বলে বাজারে ধান নিয়ে আসছি। এখন দাম কম। এখন বাজার থেকে কম দামেও মিলাররা ধান কিনছে। কিন্তু বাইরে থেকে কম দামে চাল আমদানী শুরু হলে তখন তো আমাদের ধান নিয়ে বিপদে পড়ে যাব। তাই দাম করে বাজারে ধান দিয়ে দিচ্ছি। অনেক মিলার তো ধান কিনতেও চাচ্ছে না।” 


বাংলাদেশ মেজর ও অটোমেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি শহীদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন, “সরকার যত অবৈধ মজুদারদের উপর হাত দিবে বাজারে ধান ও চালের দাম ততই কমবে। বাজারে চালের দাম কমার পেছনে মিলারদের হাত নেই। এখানে ধানের বাজার পড়ে গেছে। যখন ধানের বাজার কমে গেছে, তখন চালের দাম কমছে। এখন সরকারের উচিৎ শুধু ধানই নয়, গম, ভুট্টা, সরিষা লাইসেন্স ব্যতীত কেউ মজুদ করতে না পারে।”


এব্যাপারে দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরীর ব্যবহৃত নাম্বারের যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। 


তবে দিনাজপুর সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ জহিরুল হক বলেন, “দেশের চালের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকার বাইরে থেকে চাল আমদানী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যারা চাল আমদানী করতে চান তাদের কাছ থেকে আগামী ৭ আগষ্টের মধ্যে আবেদন নিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি আগামী আগষ্ট মাসের প্রথম থেকে সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচী চালু হচ্ছে। ইতিপূর্বে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচীর আওতায় সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, মার্চ ও এপ্রিল মাসে চাল দেয়া হলেও সরকার এবারেই প্রথম আগষ্ট সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, মার্চ ও এপ্রিল মাস চাল দিবে। গত বছর সারা দেশে ৫০ লাখ পরিবারকে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল দিয়েছিল। এবছর ৫৩ লাখ পরিবার চাল পাবে। বাইরে থেকে আমদানীর ঘোষণা ও খাদ্য বান্ধব কর্মসূচী চালু হওয়ার কারণেই বাজারে চালের দাম কমছে। বাইরে থেকে চাল আমদানী করা শুরু হলে, সামনে আরও চালের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান।”

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে