বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনার আরেকটি নতুন বাঁক নিতে চলেছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার সরাসরি ঘোষণা দিয়েছেন—ইসরায়েল যদি গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, অস্ত্রবিরতিতে সম্মত না হয় এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ করে রাখে, তাহলে আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের আগেই যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। এ ঘোষণায় পশ্চিমা কূটনীতির নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে, যা ইসরায়েলের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা বর্তমানে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেইজ ক্ল্যাসিফিকেইশন (আইপিসি) জানিয়েছে, গাজায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং অবিলম্বে খাদ্য সহায়তা না পৌঁছালে গণমৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়ছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মতে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ। গাজা প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, আর ইসরায়েলের প্রতিরোধমূলক হামলা এখন সেখানে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্টারমার তার সরকারকে একটি সুস্পষ্ট নীতিগত অবস্থানে আনেন। মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) লন্ডনে এক মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে তিনি বলেন, “গাজার দুর্ভোগ বন্ধে ইসরায়েল কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সেপ্টেম্বরেই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।”
বিবিসি ও রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের এই স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তের ওপর। এসবের মধ্যে রয়েছে:
• গাজায় মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অবরোধ শিথিল করা ও জাতিসংঘকে ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দেওয়া;
• যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়া;
• পশ্চিম তীরে ভূমি দখল বন্ধ;
• দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রতি দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই শান্তির প্রতিশ্রুতি।
স্টারমার আরও বলেন, হামাসকেও অবশ্যই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। অর্থাৎ, সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে, অস্ত্র পরিত্যাগ করতে হবে এবং গাজার প্রশাসনে তাদের আর কোনো ভূমিকা থাকবে না—এটা মেনে নিতে হবে।
যুক্তরাজ্যের ঘোষণায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, “এটি হামাসের ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করবে এবং তাদের শিকারদের শাস্তি দেবে।” তিনি আরও দাবি করেন, “আজ ইসরায়েলের সীমান্তে একটি জিহাদি রাষ্ট্র, আগামীকাল ব্রিটেনকে হুমকি দেবে।”
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বিষয়ে বলেন, “হামাসকে পুরস্কৃত করা ঠিক হবে না।” যদিও স্কটল্যান্ডে স্টারমারের সঙ্গে আলোচনায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রসঙ্গ আসেনি বলে জানান তিনি।
যুক্তরাজ্যের ঘোষণার কয়েক দিন আগেই ফ্রান্স জানায়, তারাও সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। এ ঘোষণায় ইসরায়েল ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। একই সময়ে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ বলেছেন, এখনই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় নয়; বরং এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ হওয়া উচিত।
যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরেও স্টারমারের ওপর চাপ বাড়ছিল। লেবার পার্টিসহ দেশটির প্রায় ২৫৫ জন সংসদ সদস্য যৌথভাবে একটি চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে অবিলম্বে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। অনেকের মতে, যুক্তরাজ্যের দেরিতে হলেও এ পদক্ষেপ একটি ‘সাহসী সিদ্ধান্ত’।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে ‘সাহসী’ বলে মন্তব্য করেছেন। যদিও অনেকের মতে, এই স্বীকৃতি বাস্তবে প্রতীকী হবে, কারণ পশ্চিম তীর ও গাজার বিশাল অংশ এখনো ইসরায়েলের দখলে এবং পূর্ব জেরুজালেমের ওপরও ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই।
স্টারমারের ঘোষণা ইসরায়েলের জন্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নতুন চাপের বার্তা। গাজার প্রবেশদ্বারগুলো অবরুদ্ধ থাকায় ত্রাণ কার্যক্রম একেবারে স্তব্ধ। ফলে আন্তর্জাতিক মহল ইসরায়েলের প্রতি আরও চাপ তৈরি করছে যাতে তারা অবরোধ তুলে নেয় এবং গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেয়।
যুক্তরাজ্যের সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এক বড় রূপান্তরের সূচনা করবে। এটি বিশ্ব রাজনীতির বহুদিনের জটিল গিঁট—ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা—সমাধানের পথ সুগম করতে পারে, আবার নতুন বিরোধও উসকে দিতে পারে।