জি এম কাদেরের ক্ষমতায় কাটছাঁট, নেতৃত্বে ফিরছেন আনিসুল-চুন্নুরা

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশ: ৩১ জুলাই, ২০২৫, ০৪:৩৪ পিএম
জি এম কাদেরের ক্ষমতায় কাটছাঁট, নেতৃত্বে ফিরছেন আনিসুল-চুন্নুরা

জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সাংগঠনিক সংকট এক নতুন মোড় নিয়েছে। বুধবার (৩০ জুলাই) জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) এবং দলটির যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার উপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। একইসঙ্গে দলে অব্যাহতি পাওয়া ১০ জন শীর্ষ নেতাকে আগের পদে ফিরিয়ে দিতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। 

এতে করে জাপার রাজনীতিতে আবারও পুরনো নেতৃত্বের প্রত্যাবর্তন ঘটল, যার ফলে প্রশ্ন উঠেছে, দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কাঠামো কি তবে নতুন করে গঠিত হবে?

এই রায়ের মধ্য দিয়ে কার্যত নেতৃত্বের লড়াইয়ে পিছিয়ে গেলেন জি এম কাদের এবং দৃশ্যপটে আবারও শক্তভাবে হাজির হলেন দলের একসময়ের অভিজ্ঞ ও প্রভাবশালী নেতারা—আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, মুজিবুল হক চুন্নুরা।

আদালত জানায়, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০(১)(ক) ধারা প্রয়োগ করে জি এম কাদের যে শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা আইনসঙ্গত নয়। তাই পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাকে এবং মাহমুদ আলমকে সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। একইসঙ্গে দল থেকে অব্যাহতি পাওয়া নেতাদের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদ-পদবি ফেরত দিতে হবে। তাদের নেতৃত্বে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলবে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে।

যাঁরা স্বপদে ফিরছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন—

সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার

মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু

প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ, নাজমা আক্তার, মো. জহিরুল ইসলাম জহির, মোস্তফা আল মাহমুদ, জসীম উদ্দিন ও আরিফুর রহমান খান

দপ্তর সম্পাদক-২ এম এ রাজ্জাক খান

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২৫ জুন মতবিনিময় সভায় আনিসুল, চুন্নু ও হাওলাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ওঠে। তিন দিন পর ২৮ জুন প্রেসিডিয়াম সভায় তাদের অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, যা গঠনতন্ত্রের ক্ষমতা বলে কার্যকর করেন জি এম কাদের। এরপর দলীয় ওয়েবসাইট থেকেও তাদের নাম মুছে ফেলা হয়।

তবে ১০ জুলাই সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতারা। মামলায় বলা হয়, ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা গঠনতন্ত্র পরিপন্থিভাবে জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। এরপর ২৮ ডিসেম্বর তিনি নিজে কাউন্সিল করে গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনেন, যা অবৈধ।

দলীয় নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন অনেকদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল জাতীয় পার্টিতে। জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে ‘একনায়কতন্ত্রের’ অভিযোগ তুলেছেন আনিসুল ও হাওলাদার গোষ্ঠী। তারা বলেন, জাতীয় পার্টিকে কেবল একজনের নেতৃত্বে পরিচালিত করার প্রবণতা দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং গণতন্ত্র পরিপন্থী ধারা জারি রেখেছে।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “এটা আমাদের একনায়কতন্ত্রবিরোধী লড়াইয়ের ফল। আমরা গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও শৃঙ্খলার পক্ষে। পার্টি একক মালিকানার হতে পারে না।”

রুহুল আমিন হাওলাদার এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “সত্যকে দমন করা যায় না। আমরা প্রমাণ করেছি—পার্টি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এখন সময় এসেছে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে নতুন যাত্রা শুরুর।”

জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশ গত ২৮ জুন চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে অনুমতি না পাওয়ায় সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়। এরপর তারা কাকরাইল পার্টি অফিসের সামনেই সমাবেশ আয়োজনের ঘোষণা দেন।

পাল্টা হিসেবে আনিসুল ও হাওলাদার কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বিকল্প সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এমনকি জাতীয় পার্টির ভিন্নমতাবলম্বী অংশ, রওশন এরশাদের অনুসারীদের সঙ্গে আলোচনা করে ঐক্য গঠনেরও চেষ্টা করেন তারা।

অন্যদিকে, জি এম কাদেরও বুঝে যান, তার বিরুদ্ধে একটি সাংগঠনিক চাপ বাড়ছে এবং তাকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার কৌশল নেওয়া হচ্ছে।

জাতীয় পার্টির ইতিহাসে একাধিকবার ভাঙনের সাক্ষী থেকেছে দেশ। ১৯৯৭ থেকে শুরু করে ২০১৩ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলটি বিভক্ত হয়। এবারের পরিস্থিতি অনেকটা ভিন্ন। কারণ, এবার শুধু গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব নয়, দলীয় নেতৃত্ব ও গঠনতন্ত্রের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে এসেছে, যার নিষ্পত্তি হচ্ছে আদালতের মাধ্যমে।

আদালতের এই রায় একদিকে যেমন দলীয় নেতৃত্বে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, অন্যদিকে সামনে জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে জাপার অবস্থানকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে সহায়ক হতে পারে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে