সারাদেশে মাসব্যাপী ঘুরে ঘুরে জনসম্পৃক্ততার বার্তা ছড়িয়ে রাজধানীতে ফিরে এসেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’। গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি বহনকারী এই কর্মসূচির শেষ পথসভা অনুষ্ঠিত হয় সাভারের বাইপাইলে, বুধবার (৩০ জুলাই) রাতে।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকার বাংলামোটরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পদযাত্রার বহর পৌঁছালে ফুল ছিটিয়ে ও স্লোগানে নেতাদের বরণ করে নেন ঢাকা মহানগর এনসিপির নেতাকর্মীরা। মধ্যরাতের বৃষ্টি উপেক্ষা করে অপেক্ষমাণ সমর্থকদের উদ্দেশে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন।
গত ৩০ জুন রাতে রাজধানীর বাংলামোটর থেকে শুরু হয়েছিল এই কর্মসূচি। উদ্দেশ্য ছিল—২০০৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত ‘গণঅভ্যুত্থান’-এ শহীদ ও আহতদের পরিবারগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার আহ্বান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির রূপরেখা জনগণের সামনে তুলে ধরা।
নাহিদ ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, “আবু সাঈদের কবর জিয়ারাত দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল রংপুরে। সেই শহীদ-ভূমি থেকে ঢাকার পথে এক মাসজুড়ে আমাদের এই পদযাত্রা জনগণের মধ্যে আশার আলো জ্বালিয়েছে।”
মাসব্যাপী কর্মসূচিতে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের প্রায় ৬০টি জেলা সফর করেন। কখনো গাড়িতে, আবার কখনো পায়ে হেঁটে শহর ও গ্রাম অতিক্রম করেছেন তাঁরা। তরুণ নেতাদের সক্রিয়তা, সাধারণ মানুষের আগ্রহ, এবং শহীদ পরিবারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এনসিপির জন্য নতুন রাজনৈতিক শক্তির ইঙ্গিত দিয়েছে বলে মনে করছেন দলের শীর্ষ নেতারা।
তবে পুরো যাত্রাপথ জুড়ে শান্তিপূর্ণ আয়োজন হলেও গোপালগঞ্জ ও কক্সবাজারে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন। ঘটনাটিকে ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ’ আখ্যা দিয়ে এনসিপির পক্ষ থেকে সেখানে পদযাত্রার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মার্চ ফর গোপালগঞ্জ’।
তবে গোপালগঞ্জসহ চারটি জেলা—মাদারীপুর, শরীয়তপুর, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বাতিল করা হয় নিরাপত্তা ও শোকাবহ ঘটনার প্রেক্ষিতে। ২১ জুলাই ফেনী যাওয়ার পথে ঢাকায় মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থীদের বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের খবর পেয়ে দলটি সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি পালন করে এবং রাষ্ট্রীয় শোকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের পথসভা বাতিল করে।
এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক খান মুহাম্মদ মুরসালীন জানান, এই পদযাত্রার মাধ্যমে দলটি রাজনৈতিক ভিত্তি বিস্তারে বড় ধাপ এগিয়েছে। তিনি বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য ছিল—দেশের মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা, গণঅভ্যুত্থানের উত্তরসূরিদের সম্মান জানানো এবং একটি নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মাসব্যাপী এই কর্মসূচি এনসিপির পরিচিতি তৈরি ও রাজনীতিতে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও কিছু কর্মকাণ্ড তাদের পরিপক্কতার ঘাটতির কথাও সামনে এনেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, “জনসম্পৃক্ততার এই প্রয়াস গুরুত্বপূর্ণ, তবে সরকারি সুবিধা নিয়ে চলা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। তা না হলে রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।”
পথসভার কারণে কিছু এলাকায় জনদুর্ভোগ হয়েছে স্বীকার করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “সাধারণ মানুষের যে সাময়িক দুর্ভোগ হয়েছে, তার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তবে বিশ্বাস করি, জনগণের সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক এই সাময়িক কষ্টকে ছাপিয়ে যাবে।”
তিনি জানান, “আটকে যাওয়া চারটি জেলায় আগামী ৫ আগস্টের পর পুনরায় কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ৬৪টি জেলার প্রতিটিতে আমাদের পদার্পণ হবে—এই অঙ্গীকার নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব।”