উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতার কারণে হত্যাকাণ্ড

এফএনএস এক্সক্লুসিভ | প্রকাশ: ১ আগস্ট, ২০২৫, ০৮:২৮ এএম
উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতার কারণে হত্যাকাণ্ড

বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, যার ভয়াবহ পরিণতি হিসেবে ব্যাপকহারে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই সারা দেশে দেড় হাজারেরও বেশি খুনের মামলা দায়ের হয়েছে, যার ৪০ শতাংশের অধিক ঘটেছে পারিবারিক কলহের জেরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা শুধু আইনশৃঙ্খলার সংকট নয়, বরং এটি সামাজিক সম্পর্কের ভাঙন, মানসিক স্বাস্থ্য সংকট এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, সামাজিক ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহের কারণে অবলীলায় খুন হচ্ছে মানুষ। অধিকাংশই ঘটনাই ঘটছে শিক্ষিত পরিবারে। বাবা-মায়ের হাতে সন্তান, সন্তানের হাতে বাবা-মা, পরকীয়ার কারণে স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, সম্পত্তির জেরে এক ভাই আরেক ভাইকে হত্যা করছে। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই তুচ্ছ কোনো কারণে ঘটছে। একটি ঘটনার নৃশংসতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আরেকটিকে। পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে সারাদেশে এক হাজার ৫৮৭ খুনের মধ্যে রাজধানীতে ১৬৮ জন খুন হয়। অধিকাংশ খুনের কারণই পারিবারিক। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন হচ্ছে ১০ থেকে ১২ জন। এর অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক কারণে। আর এর প্রধান শিকার নারী ও শিশু। ঢাকা মহানগরে গত পাঁচ বছরে খুনের মামলা হয়েছে এক হাজার ১০৬১টি। ২০২০ সালে ২১৯টি, ২০২১ সালে ১৬৬টি, ২০২২ সালে ১৭২টি, ২০২৩ সালে ১৬৫টি এবং ২০২৪ সালে মামলা হয়েছে ৩৩৯টি। এসব হত্যাকাণ্ডের বড় একটি অংশ ঘটেছে পারিবারিক কলহ ও দ্বন্দ্বে। হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যানে ঢাকাই শীর্ষে। তবে আয়তন বিবেচনায় ঢাকার জনসংখ্যাও সর্বাধিক। শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশেই পারিবারিক কলহ আর দ্বন্দ্বের কারণে হত্যা বাড়ছে। গত মে মাসে সারাদেশে খুনের মামলা হয়েছে ৩৪১টি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ১৮০ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা ৪০ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা ৫৮ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৭৪ জন নারী। ২০২৩ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২০৭ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৫৩ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৩২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন নারী। ২০২২ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২০৬ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৪৪ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৪২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯৭ জন নারী। ২০২১ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২২৪ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৭৩ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৭৫ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন নারী। ২০২০ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২৪০ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৭১ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৫৬ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯০ জন নারী। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১০৫৭ জন নারী। আত্মহত্যা করেন ৬৪৫ জন। সামাজিক যে অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে তার বেশিরভাগই অর্থ-সম্পদ কেন্দ্র করে। একটা সময় ছিল যখন পরিবারের মধ্যে সম্পদ ভাগাভাগি হতো না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলেছে। জমি কেন্দ্র করে এখন সামাজিক অপরাধ বেশি সংঘটিত হচ্ছে। মানসিক সমস্যাও হত্যাকাণ্ডের কারণ। এছাড়া মাদকাসক্তি ও পরকীয়ার জেরেও খুন হচ্ছে। এ রকম ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক অবক্ষয়কেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি এসব ঘটনার পেছনে প্রযুক্তিনির্ভর জীবন, সহমর্মিতার অভাব, টিভি সিরিয়ালে ক্রাইম সিন দেখে হত্যায় উৎসাহিত হওয়া এবং ব্যক্তিনির্ভর জীবন গড়ে ওঠাকে দায়ী করা হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা, একে অপরকে ছাড় দেওয়ার মনোভাব গড়ে তোলা এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্পর্কের জায়গাটা দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এর বেশ কিছু কারণ আছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট, সুস্থ পারিবারিক বিনোদনের অভাব, তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার। মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে পরস্পরের সঙ্গে বন্ধনের জায়গায় ঘাটতি হচ্ছে। এছাড়া, পারিবারিক সহিংসতা কমাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইন হয়েছে। শুধু আইন হলেই হবে না, আইনের প্রয়োগ দরকার। শুধু মেয়েরাই সহিংসতার শিকার হয় তা নয়। পুরুষ ও নারী উভয়েই সহিংসতার শিকার হয়। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে পরকীয়া অনেক বেশি বেড়েছে। মানুষের মধ্যে যে ধৈর্যশীলতা থাকা দরকার তা নেই। নৈতিকতা, মূল্যবোধ কমে গেছে। এসব মানসিক অস্থিরতা পারিবারিক সহিংসতার মূল কারণ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের অপরাধ কমাতে হলে পরিবারের পাশাপাশি সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বাড়ানোর কথাও বলছেন তারা। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সবাইকে আরও মনোযোগী হতে হবে।