দেশের অন্যতম অনলাইন ট্রাভেল প্ল্যাটফর্ম ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন হাজারো গ্রাহক ও টিকিট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। বুকিংকৃত উড়োজাহাজের টিকিট এবং আগাম অর্থ নিয়ে এই অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সালমান বিন রশিদ দেশত্যাগ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই ঘটনায় গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মতিঝিল থানায় দায়ের হওয়া মামলায় তিন কর্মচারী—সাকিব হোসেন, সাঈদ আহমেদ ও শাহাদত হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন রোববার (৩ আগস্ট) বিষয়টি নিশ্চিত করেন। মামলায় ফ্লাইট এক্সপার্টের এমডি সালমান বিন রশিদ শাহ সাঈম ও তার বাবা এম এ রশিদকেও আসামি করা হয়েছে।
২০১৭ সালের মার্চে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে উড়োজাহাজ টিকিট, হোটেল বুকিং, ট্যুর প্যাকেজ ও ভিসা প্রসেসিংয়ের মতো সেবা দিয়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। অথচ হঠাৎ এক সন্ধ্যায় রাজধানীর মতিঝিল কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভীত-উৎকণ্ঠিত গ্রাহক ও বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির প্রতিনিধিরা ভিড় করেছেন টিকিট ও অর্থ নিয়ে অজানা অনিশ্চয়তা দূর করতে।
ইউনিয়ন ট্রাভেলস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক কাঁদতে কাঁদতে জানান, “সব শেষ। আমার ভাই ২৫-৩০ লাখ টাকা নেই। এই সব টিকিট ফ্লাইট এক্সপার্টের মাধ্যমেই কাটা ছিল।” তবে পরে জানা যায়, এসব টিকিট ফ্লাইট এক্সপার্টের মাধ্যমে নয়, অন্য দুটি মধ্যস্থতাকারী এজেন্সির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
এমডি সালমান পালিয়ে যাওয়ার খবর ফাঁস হওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সাঈদ আহমেদ মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তিনি জিডিতে দাবি করেন, সালমান হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সবাইকে জানিয়ে দেশ ছেড়েছেন এবং অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন। জিডিতে আরও বলা হয়, গ্রাহকদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং কর্মীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওয়েবসাইট বন্ধ থাকার খবরে শুরু হয় ব্যাপক ক্ষোভ ও শঙ্কা। ভুক্তভোগীরা জানান, বুকিং দেওয়া হলেও টিকিট তারা পাননি, অনেকে হজ প্যাকেজ কিনে টাকা দিয়েও সাড়া পাননি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে।
অন্যদিকে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে সালমান বিন রশিদ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, “টাকা নিয়ে পালানোর সুযোগ নেই। গ্রাহকরা টাকা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই টিকিট পেয়ে যান।” উল্টো তিনি দাবি করেন, প্রতিষ্ঠানটির হেড অব কমার্শিয়াল সাঈদ আহমেদ এবং অন্য দুজন কর্মকর্তা মিলে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং প্রায় তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দেওয়া বার্তায় সালমান বলেন, “এই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই আমি ছুটি নিচ্ছি। আমি দুঃখিত, এভাবে চলে যেতে আমার ইচ্ছা ছিল না।”
তবে হেড অব কমার্শিয়াল সাঈদ আহমেদ সম্পূর্ণ বিপরীত দাবি করে বলেন, “মালিকপক্ষই টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। এখন অসংখ্য গ্রাহক এবং শত শত এজেন্সি কোটি কোটি টাকার টিকিট নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে।”
মতিঝিল সিটি সেন্টার ভবনের নিরাপত্তাকর্মীরাও জানান, সালমান প্রতিদিন অফিসে আসতেন, কিন্তু বিগত তিন দিন ধরে তিনি অনুপস্থিত।
ফ্লাইট এক্সপার্টের সেলস বিভাগের একজন কর্মী মামুনুর রশিদ জানান, "গতরাতেই আমাদের মালিক দেশ ছেড়ে গেছেন। আমরা থানায় যাচ্ছি।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের টিকিটিং বাজারে বড় অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতাই ছোট ছোট এজেন্সিগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সরাসরি এয়ারলাইনসের কাছ থেকে টিকিট সংগ্রহ না করে মধ্যস্থতাকারী এজেন্সির মাধ্যমে তা নেওয়ায় এই দুরবস্থা আরও প্রকট হয়েছে।
এমডির পলায়নের খবরে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটও বন্ধ হয়ে গেছে। অফিসের ফেসবুক পেজে সর্বশেষ পোস্টে হজ প্যাকেজের তথ্য থাকলেও সেটির পরে আর কোনো আপডেট নেই।
ভুক্তভোগী একজন গ্রাহক জয়িতা আফরিন ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, “ফ্লাইট এক্সপার্টের মতো বিশ্বস্ত একটা প্রতিষ্ঠান যদি পালিয়ে যায়, তাহলে আমরা কাকে বিশ্বাস করব?”
ফ্লাইট এক্সপার্টের বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত ও গ্রেপ্তারের এ প্রক্রিয়ায় নতুন করে দেশের অনলাইন ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রির নিরাপত্তা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একদিকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ওপর মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে, অন্যদিকে পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এ ধরনের ঘটনা বারবার সামনে আসছে।
এই মামলার তদন্তে কতদূর গড়াবে এবং গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো আশার আলো দেখা যাবে কি না—তা সময়ই বলবে।