যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়, পাল্টা শুল্ক নামছে ২০ শতাংশে

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশ: ৪ আগস্ট, ২০২৫, ১০:৫৫ এএম
যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়, পাল্টা শুল্ক নামছে ২০ শতাংশে

যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পাল্টা শুল্ক কমিয়ে আনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতে ছাড় দিতে রাজি হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে শুল্ক, বিনিয়োগ, মেধাস্বত্ব, আমদানি, সেবা খাত, শ্রম অধিকার ও পরিবেশ সংক্রান্ত নানা শর্ত। এসব ছাড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কারণেই যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এবার যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘পারস্পরিক বাণিজ্যচুক্তি’ স্বাক্ষরের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে দুই দেশ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন চুক্তি কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে সামরিক পণ্য, বেসামরিক উড়োজাহাজ ও যন্ত্রাংশ, জ্বালানি তেল, গম, তুলা, ভোজ্যতেল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি বাড়বে। এসব আমদানির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতেও রাজি হয়েছে বাংলাদেশ।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সব চাওয়া বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন শুক্রবার (১ আগস্ট) রাতে ওয়াশিংটন থেকে জানান, সব দাবি মানা সম্ভব নয় বলেই দীর্ঘ সময় ধরে দর-কষাকষি হয়েছে।

শুল্ক কমাতে হবে, তবে লাগবে আইন সংশোধন

যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব পণ্য বাংলাদেশে আমদানি হবে, সেগুলোর ওপর বর্তমানে যে আমদানি শুল্ক (সিডি), সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) আছে, তা কমানো হবে। তবে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান জানিয়েছেন, এসব ক্ষেত্রে শুল্ক কমাতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে এবং এখনো সেই পর্যায় আসেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগে শিথিল হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু খাতে বিনিয়োগের ওপর বাংলাদেশের বিধিনিষেধ রয়েছে, সেগুলো তুলে নেওয়া হবে। বিনিয়োগে অনাপত্তিপত্র (NOC) পেতে সহজতা, মূলধন স্থানান্তরে স্বচ্ছতা ও গতি আনার বিষয়ে নির্দেশিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা দ্রুত পরিশোধের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে।

পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক বোঝা থেকেই যাচ্ছে

শনিবার (২ আগস্ট) বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানান, নতুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে কার্যকর শুল্ক হার দাঁড়াবে সাড়ে ৩৬ শতাংশ, যার মধ্যে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এবং সাড়ে ১৬ শতাংশ আগের শুল্ক। তবে পোশাকের কাঁচামালের কিছু অংশ যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকেই আমদানি করা হয়, যেমন তুলা, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কিছু পণ্যে শুল্ক কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

চিকিৎসা ও খাদ্য পণ্যেও ছাড়

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) অনুমোদন পাওয়া চিকিৎসা যন্ত্র আমদানিতে বাংলাদেশ আর কোনো অতিরিক্ত কাগজপত্র দাবি করবে না। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফোরামের সদস্য হওয়ার জন্যও আবেদন করবে। খাদ্যপণ্য—বিশেষ করে দুগ্ধজাত দ্রব্য, মাংস ও ডিমজাত পণ্য—আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা মান্যতা দেবে বাংলাদেশ।

পরিবেশ, সাইবার নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা

যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ মেনে সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং ২০২১ সালের সোশ্যাল মিডিয়া ও ওটিটি সংক্রান্ত আইন পর্যালোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষা ও দুর্নীতিবিরোধী পরিকল্পনার খসড়া প্রকাশ এবং বন ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনার কথাও বলা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক চুক্তিতে যোগদানের প্রতিশ্রুতি

বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদন ও বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বার্ন কনভেনশন, মাদ্রিদ প্রটোকল, প্যারিস কনভেনশন, পেটেন্ট কো–অপারেশন ট্রিটি, ইউপিওভি ১৯৯১ প্রভৃতি।

পুনর্বিমা বাধ্যবাধকতা বাতিলের উদ্যোগ

বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা করপোরেশনের সঙ্গে ৫০ শতাংশ পুনর্বিমা বাধ্যতামূলক। যুক্তরাষ্ট্র এই বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার দাবি জানালে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক জানান, এ বিষয়ে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চুক্তি কার্যকর হলে উভয়পক্ষের লাভ

চুক্তি কার্যকর হলে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যে বাড়তি সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ ও আমদানি-রপ্তানি আরও গতিশীল হবে। পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নামায় আপাতত কিছুটা স্বস্তি মিললেও পুরো সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতিশীল সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে