সড়ক নয় যেন দুর্ঘটনার ফাঁদ

হোমনা-মুরাদনগর সড়কের ১৪ কিলোমিটার বেহাল দশা

এফএনএস (মোর্শেদুল ইসলাম শাজু; হোমনা, কুমিল্লা) : | প্রকাশ: ৫ আগস্ট, ২০২৫, ০৩:২৪ পিএম
হোমনা-মুরাদনগর সড়কের ১৪ কিলোমিটার বেহাল দশা

কুমিল্লার হোমনা ও মুরাদনগর উপজেলার সংযোগকারী প্রায় ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ আঞ্চলিক সড়কের  হোমনা উপজেলা সদর থেকে রঘুনাথপুর পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার এলাকা খানাখন্দে ভরে গেছে। এসব খানাখন্দ চরম দুর্ভোগ ও মানুষের জীবনমরনের ফাঁদে পরিণত হয়েছে। সড়কের বিভিন্ন অংশে পিচ ও কংক্রিট উঠে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে গর্ত। ভারী বর্ষণের ফলে এসব গর্তে পানি জমে থাকায় নিয়মিত ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। সড়কটি দেশের রাজধানী ঢাকা ও জেলা শহর কুমিল্লায় যাতায়াতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম। 

সড়কটি হোমনা উপজেলা সদর থেকে মুরাদনগর উপজেলার কোম্পানীগঞ্জে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এ সড়কে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়েই চলছে শত শত পণ্যবাহী ট্রাক, বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি, অটোরিকশা, অ্যাম্বুলেন্স, রিকশা ও মোটরসাইকেল। এ সব যানবাহন ঢাকা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করে। সড়কের এ বেহাল দশায় ভোগান্তিতে রয়েছেন হোমনা, তিতাস, মুরাদনগর, দেবিদ্বার ও বাঞ্ছারামপুর উপজেলার  কয়েক লক্ষ মানুষ। গত কয়েক বছরে সংস্কার না হওয়ায় বেহাল হয়ে পড়েছে সড়কটি। রাস্তার এই বেহাল দশার কারণে পরিবহনে যাত্রীদেরও গুণতে হয় অতিরিক্ত ভাড়া।

হোমনা থেকে কাশিপুর পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার এই সড়কের দুই পাশে তিনটি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। ঘাড়মোড়া, জয়পুর ও ভাষানিয়া ইউনিয়ন। সড়ক ঘেঁষে রয়েছে দুটি উচ্চ বিদ্যালয়, কয়েকটি সকরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা। এগুলো হলো- ঘাড়মোড়া উচ্চ বিদ্যালয়, কাশিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও রঘুনাথপুর দারুল উলুম ফাজিল মাদ্রাসা। এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত ঘাড়মোড়া বাজার, শ্রীপুর বাজার এবং কাশিপুর বাজার। এ সড়কে প্রতিদিন দুর্ঘটনা আর স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই চলছে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

ঘারমোড়া বাজারটি কুমিল্লা জেলা এবং দেশের অন্যতম একটি বৃহৎ গরুর হাট হিসেবে পরিচিত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন গরু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য। এছাড়াও এখানে রয়েছে একাধিক করাত কল। প্রতিদিন এসব মিলে আনা হয় বড় বড় কাঠের গুঁড়ি। যেগুলো পরিবহনের সময় প্রায়ই গর্তে আটকে পড়ে ট্রাক। ফলে সৃষ্টি হয় যানজট ও দুর্ঘটনার আশঙ্কা। 

সরেজমিন দেখা গেছে, সড়কের বিভিন্ন জায়গায় কার্পেটিং উঠে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক গর্তে পানি জমে আছে। অনেক জায়গায় গর্তের কারণে সংকুচিত হয়ে গেছে সড়ক। বিশেষ করে হোমনা চৌরাস্তার দুই শ’ মিটারের বেশি জায়গাসহ মীরশিকারি, শ্রীপুর, ঘাড়মোরা, কৃষ্ণপুর, কাশিপুর, ওমরাবাদ ও রঘুনাথপুর এলাকায় রাস্তার বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে। এ কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। রাস্তা ভাঙাচোরা থাকায় যানবাহনের চালকরা গতি কমিয়ে যাতায়াত করছেন।

ঘারমোড়া হাটে ট্রাকে করে আসা গরু ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান জানান, “গরুর হাটে আসা ক্রেতারা রাস্তায় এসে পড়ে বিপাকে। পুরা রাস্তা ভেঙে মাঝখানে গর্ত হয়ে গেছে। ট্রাক আটকে যায়। গরু উঠা-নামা করতে পারি না।”

শ্রীপুর বাজারের ফল ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে ভাঙাচোড়া রাস্তার ধুলোবালিতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে আমাদের। দোকানের মালসামান নষ্ট হচ্ছে। বৃষ্টিবাদলে রাস্তার গর্তে পানি জমে থাকে। আর গাড়ি চলাচলের সময় চাকার ছিটা কাদা-পানিতে দোকানের মালামালসহ কাপড়চোপড় নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া দুর্ঘটনাতো লেগেই আছে। অনেক বছর যাবত রাস্তার সংস্কার হয় না।’

সিএনজিচালক মো. সবুজ মিয়া বলেন, “আমার বাড়ি হোমনা পৌরসভার শ্রীমদ্দি গ্রামে। অনেক বছর যাবত হোমনা চৌরাস্তা থেকে হোমনা-মুরাদনগর সড়কের কাশিপুর রাস্তায় সিএনজি চালাই। রাস্তাটি ভাঙাচোড়ার কারণে আমরা গাড়ি চালাতে পারি না। প্রায় আট বছর যাবত রাস্তাটির অবস্থা খুবই খারাপ। চলতে গিয়ে যাত্রী নিয়ে অনেকবার রাস্তায় সিএনজি, অটোরিক্সা উল্টে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছি। গাড়ি ভেঙেছে অনেকবার। যাত্রীরাও আহত হয়েছে। অনেক ক্ষতি হয়েছে এখনও হচ্ছে।”

আশরাফুল ইসলাম একজন সবজি বিক্রেতা। তিনি বলেন, “আমি পাঁচ বছর যাবত রাস্তার পাশে সবজি বিক্রি করছি। এর মধ্যে দেখিনি রাস্তায় কোনো কাজ হতে। এসময়ে ভাঙা রাস্তার ওপরে অনেক গাড়ির দুর্ঘটনা দেখেছি। এ ভাঙাচোড়া রাস্তায় দুর্ঘটনায় পড়ে অনেক গাড়ির ক্ষয়ক্ষতি এবং যাত্রীদের আহত হতে দেখছি।”

সত্তরোর্ধ বয়েসী আবদুল মোতালেব বলেন,“ দীর্ঘদিন রাস্তা সংস্কার না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে গাড়ি চরাচল করতে পারছে না। প্রতিদিনই গাড়ির জট লেগে থাকে। পথচারীদেরও মারাত্মক ভোগান্তি হয়।”

রিক্সাচালক আলা উদ্দিন বলেন, “আমাদের অবস্থা তো খুবই খারাপ। উঁচা-নিচা ভাঙা রাস্তা, বড় বড় গর্ত; তিন চাকার রিক্সা নিয়া রাস্তার নামি। কিন্তু পেসেঞ্জার উঠতে চায় না। রিক্সাই আমার আয় রোজগারের একমাত্র সম্বল। ঠিকমতো পেসেঞ্জার টানতে পারিনা বলে কষ্টে কোনো রকমে জীবন চলে। রাস্তাটি দ্রুত মেরামত করাা দরকার।”

স্থানীয় এক স্কুলছাত্রী আফরোজা বলেন, “প্রতিদিন স্কুলে যেতে ভয় লাগে। কখন রিকশা গর্তে উল্টে যায়, বলা যায় না। কখনো পানি ঢ়ুকে জুতো খুলে হেঁটেই যেতে হয়।”

সাদেক মিয়া একজন নিয়মিত মোটরসাইকেল চালান। তিনি বলেন, “সামান্য অসতর্কতায় দুর্ঘটনা ঘটছে। পানি থাকলে তো আর বুঝা যায় না। কোন দিকে কী পরিমাণ গর্ত। হুট করেই পড়ে যেতে হয় সে গর্তে।”

স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হক সরকার বলেন, “ চৌরাস্তা থেকে রিক্সাচালকরাও আমাদের নিতে চায় না। রাস্তা এতোটাই ভেঙে বেহাল হয়েছে যে, রিক্সাও টানা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। তাছাড়া কোনো কারণে রিক্সায় উঠলেও আমাদের কোমড়ের হাড়গোড় যেন এপাশ ওপাশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। রিক্সায় দুই-একবার উঠলেই কোমড় ও পিঠের ব্যথায় ডাক্তারের কাছে আবশ্যই যেতে হয়। বৃষ্টির দিনে তো গর্তও দেখা যায় না। কে জানে কখন কী ঘটে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা কি এমন অসহনীয় ভোগান্তি থেকে নিস্তার পাবো না?

ঘাড়মোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান মোল্লা বলেন, “এ রাস্তাটি গত ২০১৬ সালে একবার সড়ক ও জনপথ বিভাগ সংস্কার করেছিল। এখন হোমনা থেকে কাশিপুর পর্যন্ত রাস্তাটি খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। কোনো যানবাহন এমনকি মানুষও ঠিকমতো চলতে ফিরতে পারে না। প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়টি আমি ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনিও সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু কিছুই হলো না। মাঝে একবার আমি ব্যক্তিগতভাবে ঘাড়মোড়া বাজার সংলগ্ন রাস্তাটি মাটি দিয়ে প্রাথমিকভাবে মেরামত করে দিয়েছিলাম।”

হোমনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্ষেমালিকা চাকমা বলেন, “হোমনা কাশিপুর পর্যন্ত সড়কটি নিয়ে জেলা সমন্বয় সভায় একাধিকবার আলোচনা করেছি। বলার পর তারা বিভিন্ন সময় ছোটোখাটো মেরামত করে ঠিকই। কিন্তু এতে আমাদের হচ্ছে না। এ রাস্তায় জরুরী ভিত্তিতে বড় ধরনের সংস্কার কাজ প্রয়োজন।”

কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের গৌরীপুর সড়ক উপ-বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম ভূঁঞা বলেন, এ রাস্তার টেন্ডার হয়েছে। এখন কার্যাদেশ প্রক্রিয়াধীন। খুব শিগগিরই পুরা রাস্তায় কাজ হবে। আর যেখানে চরম বিপর্যয়, গাড়ি চলতে সমস্যা হয় সেখানে ট্রাক পাঠাবো। কবে নাগাদ কাজ শুরু হতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, আশা করি এক সপ্তাহের মধ্যে কার্যাদেশটি শুরু হবে। তা হলে আগস্টের মধ্যেই কাজ শুরু হবে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে