দারিদ্র্যকে শুধু আয়-ব্যয়ের ভিত্তিতে দেখার দিন ফুরিয়েছে বহু আগেই। আধুনিক উন্নয়ন ভাবনায় দারিদ্র্য মানে কেবল অর্থের অভাব নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মৌলিক জীবনযাপনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকার একটি বহুমাত্রিক বাস্তবতা। এ দেশেরও বাস্তব চিত্র আলাদা কিছু নয়। বরং সাম্প্রতিক এক জরিপে প্রকাশিত তথ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে-জাতীয় প্রবৃদ্ধির অগ্রযাত্রা যতই উচ্চারিত হোক না কেন, সমাজের এক বিরাট অংশ এখনো মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত। গত ৩১ জুলাই পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) দেশের প্রথম জাতীয় বহুমাত্রিক দরিদ্র সূচক প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, দেশে বহুমাত্রিক দরিদ্রের হার ২৪ দশমিক ০৫ শতাংশ, যা সাধারণ বা আয়ভিত্তিক দরিদ্রতার চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। এই সূচক অনুযায়ী, দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ এমন সব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, যা একটি সম্মানজনক ও সুরক্ষিত জীবনের জন্য অপরিহার্য। এই দারিদ্র্য একক নয়-এটি বহুস্তরীয়। পুষ্টিহীনতা, স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, স্কুলে না যাওয়া কিংবা অপ্রতুল শিক্ষাবছর, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ, রান্নার জ্বালানি, বাসস্থান ও ইন্টারনেটের অভাব-এসব মিলিয়েই গঠিত হয় এই দারিদ্র্য। এ সূচকের গুরুত্ব এখানেই যে, এটি কেবল অর্থনৈতিক চিত্র নয়, বরং উন্নয়নের মানবিক দিককে প্রকাশ করে। জেলা ও বিভাগীয় পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক বৈষম্যের কথা বলে। বান্দরবানে বহুমাত্রিক দরিদ্র সূচক (এমপিআই) হার ৬৫ শতাংশ, কক্সবাজার ও সুনামগঞ্জে ৪৭ শতাংশ, অন্যদিকে ঝিনাইদহে তা মাত্র ৯ শতাংশ। খুলনা বিভাগে বহুমাত্রিক দরিদ্রের হার সবচেয়ে কম (১৫ শতাংশ), আর সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে (৩৭.৭ শতাংশ)। এই ধরনের অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য কেবল ভৌগোলিক বাস্তবতার ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত অগ্রাধিকার ও সম্পদ বণ্টনের ব্যবধানকে নগ্ন করে দেয়। আরো গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো-শিশুদের মধ্যে বহুমাত্রিক দরিদ্রতার হার প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় অনেক বেশি, প্রায় ২৯ শতাংশ। এর মানে, একটি বড় অংশ জন্মের পর থেকেই বঞ্চনার চক্রে প্রবেশ করছে, যা ভবিষ্যৎ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা, স্বাস্থ্য ও সম্ভাবনাকে সীমিত করে দিচ্ছে। নারী ও পুরুষের মধ্যে দারিদ্র্যের হারে ব্যবধান না থাকলেও, প্রান্তিক নারীরা আরও বেশি ঝুঁকির মুখে-বিশেষত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার দিক থেকে। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় এমপিআই সূচক নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। এটি কেবল পরিমাপ নয়, বরং বাস্তব ভিত্তিক পরিকল্পনার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনামূলক হাতিয়ার। তবে এটি তখনই কার্যকর হবে, যখন এই সূচকের আলোকে সম্পদ বরাদ্দ, বাজেট পরিকল্পনা ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম সাজানো হবে। জিইডি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বহুমাত্রিক দরিদ্রতা কমাতে প্রয়োজন জরুরি ও বহুমুখী হস্তক্ষেপ-বিশেষত শিক্ষায় বিনিয়োগ, আবাসন, স্যানিটেশন ও ইন্টারনেট সুবিধা সম্প্রসারণে সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া জেলা ও অঞ্চলের জন্য বিশেষ বরাদ্দ, সামাজিক সুরক্ষা ও স্থায়ী অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এই বৈষম্য হ্রাস করাই হতে হবে পরবর্তী করণীয়।