দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দীর্ঘসময় চাপে থাকার পর ফের ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রবণতায় ডলারের সরবরাহ বেড়েছে, যার ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্ধারিত মানদণ্ড বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ‘গ্রস’ বা মোট রিজার্ভ এখন ৩০ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বুধবার (৬ আগস্ট) রাতে এসব তথ্য জানিয়েছেন। একই দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, রিজার্ভ বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময়মূল্য কিছুটা কমে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সাম্প্রতিক সময়ের রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়।
২০২৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম পাঁচ দিনেই প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৩২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। যা দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসেবে) দাঁড়ায় প্রায় ৪ হাজার এক কোটি টাকা। এ অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার বেশি।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও রেমিট্যান্সের ধারা ছিল উর্ধ্বমুখী। ওই মাসে এসেছে ২৪৭ কোটি ৭৯ লাখ ডলার (প্রায় ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার)। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পুরো সময়জুড়ে (জুলাই-জুন) মোট ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
রেমিট্যান্স বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি রিজার্ভ ঘুরে দাঁড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ডলারের বাজারে চাপ হ্রাস পেয়েছে এবং টাকার বিপরীতে বিনিময় হার কিছুটা কমে এসেছে।
চলতি বছরের জুলাই মাসে ডলার সরবরাহ চাহিদার তুলনায় বেশি হয়ে পড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ বাড়ানোর পথে হাঁটে। তিন ধাপে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে মোট ৫০ লাখ ডলার কিনে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বাজারে ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত তারল্য এসেছে। এই পদক্ষেপে রিজার্ভেও তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, রিজার্ভের তিনটি ধরণ রয়েছে:
১. মোট রিজার্ভ (গ্রস) — যেখানে সরকারি বিভিন্ন তহবিলের অর্থ অন্তর্ভুক্ত হয়।
২. আইএমএফের বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে পরিমাপকৃত রিজার্ভ — আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও ঋণগ্রহণ উপযোগী পরিমাণ।
৩. ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ — যা বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদাভাবে হিসাব রাখে, তবে প্রকাশ করে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি রয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ ধরা হলে, এই রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের বেশি আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব।
চলমান অর্থবছরের শুরুতে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বাড়ার পাশাপাশি আমদানি খরচ নিয়ন্ত্রণে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরেছে। গত ১০ মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেনি, যা রিজার্ভ ধরে রাখার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
এ ছাড়া সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে কাঠামোগত সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়ায় বৈদেশিক সহায়তা বাড়ছে। এতে বাজেট সহায়তা, ঋণ এবং প্রকল্পভিত্তিক অর্থায়ন বাবদ কয়েক বিলিয়ন ডলার আসছে দেশে, যার ইতিবাচক প্রতিফলন পড়ছে রিজার্ভে।
২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে—৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। তবে কোভিড-পরবর্তী সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভে চাপ পড়ে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক খাতে দুর্বল তদারকি এবং অর্থপাচারের মতো বিষয়গুলো রিজার্ভ হ্রাসে প্রভাব ফেলে।
এই সংকটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে, যা রিজার্ভ আরও কমিয়ে দেয়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ ২০২২ সালের জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা চায়।
বর্তমানে রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় এবং বৈদেশিক সহায়তার সম্মিলিত প্রভাবে দেশ আবার ধীরে ধীরে রিজার্ভ বৃদ্ধির পথে হাঁটছে।