গাজার ত্রাণের ট্রাক উল্টে প্রাণ গেল ২৫ জনের, একদিনেই নিহত ৪৯ ফিলিস্তিনি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
| আপডেট: ৭ আগস্ট, ২০২৫, ০২:৫৫ পিএম | প্রকাশ: ৭ আগস্ট, ২০২৫, ১২:১১ পিএম
গাজার ত্রাণের ট্রাক উল্টে প্রাণ গেল ২৫ জনের, একদিনেই নিহত ৪৯ ফিলিস্তিনি

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় মানবিক বিপর্যয় আরও ঘনীভূত হয়েছে। খাবার আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সংগ্রামরত মানুষের ভিড়ের ওপর উল্টে পড়েছে একটি ত্রাণবাহী ট্রাক। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২৫ জন। মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাতে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে বলে গাজা সিভিল ডিফেন্সের বরাতে জানিয়েছে সৌদি গেজেট। বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী দিনটি ছিল বুধবার (৬ আগস্ট)।

ঘটনাটি ঘটে এমন এক সময়, যখন অবরোধে জর্জরিত গাজায় প্রতিদিন প্রায় ২৪ লাখ মানুষ জীবন রক্ষার জন্য খাদ্য ও পানির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই দিন কয়েকটি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করে। ক্ষুধার্ত মানুষের ঢল নামে সেগুলোর দিকে। কেউ কেউ গাড়ির ওপর উঠে পড়েন। এ সময় চালকেরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন, একপর্যায়ে ট্রাকগুলোর একটি উল্টে অপেক্ষমাণ জনতার ওপর পড়ে।

ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ‘ওয়াফা’ এবং তুরস্কভিত্তিক ‘আনাদোলু’ জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনীর চাপে ট্রাকগুলোকে একাধিকবার ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ রাস্তা দিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। সেই অসম, ক্ষতবিক্ষত পথেই ঘটে দুর্ঘটনাটি।

এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অনেকেই। গাজার হাসপাতালগুলোতে হতাহতদের ঢল নামে মঙ্গলবার রাত থেকে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এত বেশি আহত আসছে যে, চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব ও বিদ্যুৎঘাটতির মধ্যেই চলছে এই মানবিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা।

গাজার মিডিয়া অফিস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “ইচ্ছাকৃতভাবে দখলদার ইসরায়েল ত্রাণ বহনকারী চালকদের অনিরাপদ রাস্তায় চালাতে বাধ্য করছে। এই পথেই ক্ষুধার্ত জনতা অপেক্ষা করে থাকে। ফলে হতাশ ও মরিয়া মানুষ দলবেঁধে ট্রাকগুলোর দিকে ছুটে যায়, কখনোবা ছিনতাইয়ের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়।”

এদিকে একই দিনে, অর্থাৎ বুধবার (৬ আগস্ট) গাজার বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় আরও অন্তত ২৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আনাদোলু। দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি গুলিতে মারা গেছেন পাঁচজন। মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে একটি অ্যাপার্টমেন্টে বিমান হামলায় একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হন এবং আহত হন আরও ২০ জন।

গাজার রাজধানী শহরে ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে মাত্র ছয় মাস বয়সী এক শিশু। একই শহরের দুটি আবাসিক ভবনে বোমা হামলায় আরও আটজন প্রাণ হারান, যাদের মধ্যে কয়েকজন শিশু রয়েছে। দেইর আল-বালাহ এলাকার একটি আশ্রয়কেন্দ্রেও গুলিবর্ষণে প্রাণ হারিয়েছেন আরও পাঁচজন।

জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা জানিয়েছে। চলতি বছরের ২ মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজার সব প্রবেশপথ বন্ধ রেখেছে। ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধ ও মানবিক সহায়তা প্রবেশে বড় বাধা সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, প্রতিদিন যেখানে ছয় হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক প্রয়োজন, সেখানে ২৭ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত ১১ দিনে মাত্র ৮৪৩টি ট্রাক প্রবেশ করতে পেরেছে।

ফিলিস্তিনি পরিসংখ্যান বলছে, ২৭ মে থেকে যুক্তরাষ্ট্র-চালিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর আশপাশে ত্রাণ সংগ্রহের চেষ্টায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৫৬৮ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন আরও ১১ হাজার ২৩০ জন।

বুধবার (৬ আগস্ট) আল-জাজিরা এক প্রতিবেদনে জানায়, একই দিনে অপুষ্টিজনিত কারণে মারা গেছেন আরও তিনজন ফিলিস্তিনি—এক শিশু, এক নবজাতক এবং জাবালিয়া এলাকার একজন প্রাপ্তবয়স্ক।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় অপুষ্টি ও অনাহারে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৮৮ জন, যাদের মধ্যে অর্ধেকই শিশু।

গাজায় খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও চিকিৎসাসেবার ভয়াবহ ঘাটতি এবং ইসরায়েলি অবরোধের প্রেক্ষাপটে একটি ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে গোটা উপত্যকা। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সহায়তা প্রবেশের অনুমতির জন্য বারবার আহ্বান জানালেও, কার্যত পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।