বন্ধুত্বে উষ্ণতা, নীতিতে ঠান্ডা—ভারত-মার্কিন সম্পর্ক কোন পথে?

এফএনএস | প্রকাশ: ৭ আগস্ট, ২০২৫, ০২:৩৭ পিএম
বন্ধুত্বে উষ্ণতা, নীতিতে ঠান্ডা—ভারত-মার্কিন সম্পর্ক কোন পথে?

যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচিত, কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ওয়াশিংটন ও দিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে অতীতের তুলনায় অনেকটাই জটিল ও অস্থির। বাণিজ্যিক টানাপড়েন, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা এবং মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপ—সব মিলিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বার শপথ নেওয়ার পর মোদি বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধানদের একজন হিসেবে হোয়াইট হাউসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অতীতে ট্রাম্প-মোদি একাধিকবার একে অপরের জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন এবং নিজেদের ‘বন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দিল্লিকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হলো।

বুধবার (৬ আগস্ট) ট্রাম্প ভারতের ওপর আমদানি শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করেন। এর আগে জুলাই মাসের শেষদিকে ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছিল তাঁর প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ভারত রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করছে। সে কারণেই ভারতের ওপর এই চাপ প্রয়োগ।

ভারত অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানকে ‘অন্যায্য, অযৌক্তিক ও অসংগত’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র সেদিন এক বিবৃতিতে বলেন, “ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছে একান্তই বাজার পরিস্থিতির ভিত্তিতে এবং দেশের ১৪০ কোটির মানুষের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”

দুই দেশের মধ্যে চলমান বাণিজ্যচুক্তির আলোচনায়ও অগ্রগতি নেই। ট্রাম্প ১ আগস্টের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। ভারত কিছু মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক কমালেও পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যচুক্তি হয়নি। ট্রাম্প এরপরই নতুন করে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। বিষয়টিকে ‘চাপ প্রয়োগের কৌশল’ হিসেবে দেখছেন সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়েত। তাঁর মতে, ভারত এখনো মাথা নোয়ায়নি, কারণ কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পখাত রক্ষা করা তাদের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, একদিকে যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত যেন তাদের প্রযুক্তি, কৃষিপণ্য ও ওষুধের বাজারে আরও প্রবেশাধিকার দেয়; অন্যদিকে ভারত মনে করে, এই চাহিদাগুলো তার ক্ষুদ্র শিল্প ও কৃষকের স্বার্থের পরিপন্থী। তাই ভারতের অবস্থান কিছুটা রক্ষণশীল এবং আত্মরক্ষামূলক। এতে দুই পক্ষের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়ছে।

এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও ওয়াশিংটনের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ভারত ব্যাপকভাবে রুশ তেল আমদানি শুরু করে। শুধু তাই নয়, ২০২৪ সালে মোদি দুইবার রাশিয়া সফর করেন এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছ থেকে রাশিয়ার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেখানে পুতিন একঘরে, সেখানে মোদির এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ।

রাশিয়া ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। প্রতিরক্ষা, পারমাণবিক প্রযুক্তি, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা–এসব ক্ষেত্রেও দুদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ফলে রাশিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির কৌশলে ভারতকে পাশে না পাওয়ায় ট্রাম্প প্রশাসন হতাশ ও ক্ষুব্ধ।

এর মধ্যেই গত শনিবার নরেন্দ্র মোদি নিজের রাজনৈতিক বক্তব্যে বলেন, “যা কিছু কিনব, তা যেন ভারতীয়ের ঘামে তৈরি হয়।” বক্তব্যটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন ভারতের পক্ষ থেকে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধের ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি।

বিশ্বজিত ধর, যিনি একজন খ্যাতনামা বাণিজ্য বিশ্লেষক, তাঁর মতে, “গত কয়েক দশকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এতটা নিচে নামেনি।” তিনি মনে করেন, এমনকি বাংলাদেশের মতো দেশও তুলনামূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কম শুল্কের সুবিধা পাচ্ছে।

সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, মোদি-ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্ক যতই উষ্ণ হোক না কেন, তা দুই দেশের বাস্তব বাণিজ্য ও কৌশলগত দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারছে না। উভয় দেশই কঠোর অবস্থানে রয়েছে এবং সমঝোতার পথ আপাতত সুদূরপরাহত।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে