সৈয়দপুর রেল শ্রমিকদের দাবি আদায়ের চত্বর বেলতলা এখন শুধুই স্মৃতি

এফএনএস (ওবায়দুল ইসলাম; সৈয়দপুর, নীলফামারী) : | প্রকাশ: ১৮ আগস্ট, ২০২৫, ০২:৪৭ পিএম
সৈয়দপুর রেল শ্রমিকদের দাবি আদায়ের চত্বর বেলতলা এখন শুধুই স্মৃতি

নীলফামারীর সৈয়দপুরে দেশের বৃহৎ রেলওয়ে কারখানা। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত এ কারখানায় জনবল ছিল প্রায় ১৬ হাজার। পাকিস্তান আমলে ১০ হাজার ৫শ শ্রমিক কর্মচারী ও কর্মকর্তার কর্মস্থল ছিল সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শ্রমিকদের কর্মস্থলে ঠিক সময় আসার জন্য সকাল সাড়ে ৬ টায় দেয়া হয় একটি হুইসেল বা শিটি। ওই বিকট হুইসেলের শব্দ শুনে শ্রমিকরা কারখানায় আসার সময় নির্ধারণ করতো। তারপর শেষ হুইসেল দেয়া হয় ৭ টায়। এটি শুনে শ্রমিকরা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শুরু করতো। বিশেষ করে পার্বতীপুরে অবস্থানরত শ্রমিকরা রেলওয়ে কারখানায় যাতায়াত করতো শাটল ট্রেনে। আবাসন সমস্যা সমাধানে সৈয়দপুরের পাশে সংগলশী ইউনিয়নে রেলওয়ের উপ-শহর গড়তে কয়েক শ একর ভূমি সেই সময় অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। বর্তমানে রেলওয়ের ওই জমিতে উত্তরা ইপিজেড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

নিজেদের অধিকার আদায়ে রেলওয়ে শ্রমিক যেমন সোচ্চার ছিল তেমনি জাতীয় আন্দোলনে রেখেছে শক্ত ভূমিকা। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি শাসক আইয়ুবের বিরুদ্ধে সৈয়দপুরে যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো তার প্রধান সহায়ক শক্তি ছিল রেলওয়ের শ্রমিক কর্মচারীরা। এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার হয়ে উঠেছিল সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। আর এসব সভা সমাবেশ হতো সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার প্রধান ফটক সংলগ্ন ঐতিহাসিক রেলওয়ের বেলতলায়। 

সকাল ও দুপুরে দুই বেলায় শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ ব্যানার টাঙিয়ে সভা-সমাবেশ করতো এখানে। দলীয় ভেদাভেদ ভুলে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী উপস্থিত থাকতো সেই সব সমাবেশে।

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বেশ কয়েকবার এই বেলতলায় শ্রমিক জনসভা করে গেছেন। ট্রেড ইউনিয়নের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এখানে যাওয়া আসা করতেই থাকতো হরহামেশা।

শ্রমিক আন্দোলনের তাপে সেই সময় নীলফামারী মহকুমা প্রশাসক (বর্তমানে জেলা) সৈয়দপুরেই অফিস করতেন। আর রেলওয়ের পুলিশ সুপার অফিসতো সৈয়দপুরে এখনো আছেই।

কালের বিবর্তনে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের আন্দোলনের ঐতিহ্য বিলীন হতে চলেছে। ঐতিহাসিক বেলতলায় শ্রমিক সমাবেশ না থাকায় সেখানে গজিয়েছে ঘাস। আধুনিকতার দোহাইয়ে শ্রমিক কর্মচারীর সংখ্যা কমে এসেছে। বর্তমানে মঞ্জুরি,পদের সংখ্যা তিন হাজার থাকলেও কর্মরত আছে ৮শ জনের কাছাকাছি। দীর্ঘদিন ধরে নতুন লোক নিয়োগ বন্ধ থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

ক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কার্যক্রম না থাকায় আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। ফলে কর্মকর্তাদের মর্জি মাফিক সবকিছু হচ্ছে। গণতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলোর আন্দোলন-সংগ্রাম থাকলে কর্মকর্তারা মনের ইচ্ছায় হ্যাঁ কে না আর না কে হ্যাঁ করতে পারতো না। রেলওয়ে কারখানাও চলতো জোরদারভাবে। বিশেষ করে শ্রমিক সংগঠনগুলো আন্দোলন থেকে দূরে থাকায় ইতোমধ্যে ২৯টি সপের (উপ-কারখানা) মধ্যে ৯ টি বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে কারখানার প্রাণ টুল রুম ও মেশিন সপগুলোও বন্ধ। এই দুই সপে রেলওয়ের সাত হাজার খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি হতো। বর্তমানে এই দুটি সপ বন্ধ থাকায় সকল খুচরা যন্ত্রাংশ স্থানীয়ভাবে কেনা হচ্ছে। এতে করে পকেট মোটা হচ্ছে কর্মকর্তা আর ঠিকাদারের। শ্রমিক সংগঠনগুলোর আন্দোলন সংগ্রাম চালু থাকলে এমনটা হতো না বলে মন্তব্য কারখানার শ্রমিকদের।

বাংলাদেশ রেল শ্রমিক ইউনিয়ন কারখানা শাখার সভাপতি প্রবীণ শ্রমিক নেতা আব্দুর রাজ্জাক  বলেন, 'বিগত ২০০৯ সালে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসীন হলে স্থানীয় রেলওয়ে শ্রমিক লীগের বাঁধায় আমরা বিরোধী ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো দাবি আদায়ে ঐতিহাসিক বেলতলায় কোন মিটিং মিছিল করতে পারি নাই।

আরেক নেতা বলেন,ওই সময় সবকিছু ছিল আওয়ামীলীগের দখলে। তারা যা মন চায় তাই করেছে। সে সময়ের চুরি আজ রেলকে ধ্বংশ করেছে। তবে তাদের সাথে কিছু শ্রমিকলীগ নেতা ও রেল কর্মকর্তা জড়িত ছিল। তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে