সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্র ও রেলওয়ে বাঙ্কার এলাকায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ঘটনায় পরিবেশ ও প্রাকৃতিক নান্দনিকতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পরিস্থিতি তদন্তে বুধবার (২৭ আগস্ট) সিলেট সার্কিট হাউসে গণশুনানি আয়োজন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি।
কমিটির আহ্বায়ক ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) জাহেদা পারভীন শুনানিতে সভাপতিত্ব করেন। কমিটির অন্যান্য সদস্যরাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। গণশুনানিতে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশ প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি ছাড়াও পরিবেশবাদী সংগঠন, ট্রাক পরিবহন মালিক সমিতি, পাথর ব্যবসায়ী সমিতি ও প্রেসক্লাব নেতারা বক্তব্য দেন। তারা অভিযোগ করেন, প্রশাসন ও প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে সাদাপাথর এলাকা থেকে বেপরোয়াভাবে পাথর লুট করা হয়েছে।
সরেজমিন তদন্ত ও প্রাথমিক প্রতিবেদন
এর আগে মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) তদন্ত কমিটি ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে। গত ২০ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ উচ্চ পর্যায়ের পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। গঠনের পর থেকেই কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম শুরু করে।
এদিকে, এর আগে জেলা প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৃথক দুটি তদন্ত করে। দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাদাপাথর লুটে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ওসিসহ মোট ৫৩ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। এদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী রয়েছেন ৪২ জন।
অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে শতাধিক ব্যক্তির সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেলেও কোনো নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে দুদকের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, পাথরবাহী প্রতিটি ট্রাক থেকে কমিশন আদায়ের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।
পরিবেশ ধ্বংস ও পর্যটন সংকট
সিলেট অঞ্চলের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র। পাহাড়ঘেরা এ এলাকা শুধু দেশীয় নয়, বিদেশি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় একটি স্পট। কিন্তু অবৈধভাবে রাত-দিন পাথর উত্তোলনের ফলে সেখানে বড় গর্ত তৈরি হয়েছে, নষ্ট হয়েছে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ, ধ্বংস হয়েছে সবুজ বৃক্ষরাজি। এ কারণে পর্যটনকেন্দ্রের নান্দনিকতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ভোলাগঞ্জে পর্যটনকেন্দ্র ঘিরে অনেক মানুষের জীবিকা গড়ে উঠেছিল। অবৈধ পাথর উত্তোলনের ফলে পর্যটক কমেছে, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ স্থানীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘোড়ার গাড়ি কিংবা নৌকা ভাড়া দিয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারাও চরম সংকটে পড়েছেন।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা?
দুদকের প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে-প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের নীরব সম্মতিতে প্রতিদিন শত শত ট্রাক পাথর লুট হয়েছে। প্রতি ট্রাক থেকে নির্দিষ্ট হারে অর্থ আদায় করে বিভিন্ন মহলে ভাগ করা হতো। তদন্তে প্রায় ২৫ লাখ ঘনফুট পাথর অবৈধভাবে উত্তোলনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কিছু অংশ জেলা প্রশাসন উদ্ধার করে পর্যটন এলাকায় প্রতিস্থাপন করেছে।
গণশুনানিতে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর নেতারা বলেন, অবৈধ লুটপাটে জড়িতদের নাম প্রকাশ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে ভবিষ্যতে পরিবেশ ধ্বংস ঠেকানো সম্ভব হবে না। তারা আরও অভিযোগ করেন, বহুবার প্রশাসনকে অবহিত করা হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
কমিটির বক্তব্য
গণশুনানিতে কমিটির আহ্বায়ক জাহেদা পারভীন বলেন, সরকার এ ঘটনায় শীর্ষ পর্যায়ে উদ্বিগ্ন। এজন্যই উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি অংশগ্রহণকারীদের কাছে তথ্য ও প্রমাণ তুলে ধরার আহ্বান জানান।
কমিটির অন্য সদস্যরা বলেন, গণশুনানিতে প্রাপ্ত অভিযোগ, বক্তব্য ও প্রমাণাদি প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অবহেলার প্রমাণ মিলবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবে।
জনমত ও ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর লুটের ঘটনা ইতোমধ্যেই জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষ মনে করেন, প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে প্রশাসনের দায়িত্বশীল ভূমিকা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু উল্টো প্রশাসনের অবহেলা ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশেই এই দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো-দুদক, জেলা প্রশাসন এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তদন্তে অভিযুক্তদের তালিকা প্রকাশিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে? অনেকেই আশঙ্কা করছেন, রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এই তদন্তও হয়তো আগের মতোই থেমে যাবে।
তবে পরিবেশবাদীরা মনে করছেন, এবারের গণশুনানি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয়, তবে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর শুধু সিলেট নয়, গোটা দেশের জন্য একটি অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদ অবৈধভাবে লুট হয়ে যাওয়া দুঃখজনক এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার জ্বলন্ত উদাহরণ। গণশুনানিতে উঠে আসা অভিযোগ ও তথ্য যদি কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা এবং পরিবেশ সুরক্ষায় এটি নতুন অধ্যায় হতে পারে। অন্যথায়, এ ধরনের তদন্ত কমিটি কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই থেকে যাবে-এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।