অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ইসরায়েলের অব্যাহত অবরোধ ও হামলার কারণে জীবনরক্ষাকারী খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা প্রবেশে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় অনাহার ও অপুষ্টিতে মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বুধবার (২৭ আগস্ট) থেকে বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) পর্যন্ত নতুন করে আরও ১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে দুটি শিশু রয়েছে। এ নিয়ে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ক্ষুধাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১৩ জনে, যার মধ্যে ১১৯ শিশু। খবর আল জাজিরার।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলেছে, গাজায় দুর্ভিক্ষ আর কোনো সম্ভাবনা নয়, বরং তা এখন কঠিন বাস্তবতা। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক উপপ্রধান জয়েস মুসুইয়া নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, উত্তর-মধ্য গাজায় বিশেষ করে গাজা সিটিতে দুর্ভিক্ষ ইতোমধ্যেই নিশ্চিত হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ এই সংকট দক্ষিণের দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনিস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে গাজার পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ অনাহার ও মৃত্যুর ঝুঁকিতে আছেন, এবং সেপ্টেম্বরের শেষে এই সংখ্যা ৬ লাখ ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। পাঁচ বছরের কম বয়সী অন্তত এক লাখ ৩২ হাজার শিশু মারাত্মক পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ হাজার শিশু আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই প্রাণঘাতী অবস্থায় পৌঁছাতে পারে। মুসুইয়া স্পষ্ট করে বলেন, ‘এটি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা খরার কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ নয়; এটি সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট বিপর্যয়—যুদ্ধের পরিণতি।’
অন্যদিকে, ইসরায়েল জাতিসংঘ সমর্থিত দুর্ভিক্ষ পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)-র সাম্প্রতিক প্রতিবেদন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক এডেন বার টাল প্রতিবেদনটিকে ‘ত্রুটিপূর্ণ ও অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়েছেন। তবে নিরাপত্তা পরিষদের যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি ১৪ সদস্য দেশ আইপিসি–র প্রতিবেদনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, ‘গাজায় দুর্ভিক্ষ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।’ একইসঙ্গে তারা তাৎক্ষণিক, নিঃশর্ত ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।
শিশু সুরক্ষা সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন–এর প্রধান ইঙ্গার অ্যাশিং নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া বক্তব্যে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, গাজার শিশুদের পরিকল্পিতভাবে অনাহারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তার ভাষায়, ‘ক্ষুধাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ তিনি জানান, গাজার ক্লিনিকগুলো এখন কঙ্কালসার শিশুতে ভর্তি, তারা এতটাই দুর্বল যে কান্না করারও শক্তি নেই। অনেক শিশু শুধু খাবারের ছবি আঁকছে, এমনকি কেউ কেউ মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করছে। অ্যাশিং একটি শিশুর লেখা উদ্ধৃত করে বলেন, “ইশ, আমি যদি আমার মায়ের কাছে স্বর্গে থাকতে পারতাম। সেখানে ভালোবাসা আছে, খাবার আছে, পানি আছে।”
এদিকে ওয়াশিংটনে বুধবার (২৭ আগস্ট) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও সাবেক মধ্যপ্রাচ্য দূত জ্যারেড কুশনারসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আলোচনায় যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা পুনর্গঠন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেছেন, দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই গাজার যুদ্ধের সুনির্দিষ্ট সমাপ্তি ঘটবে, যদিও যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন পরিকল্পনা ছাড়া গাজার পুনরুদ্ধার কার্যত অসম্ভব হবে। কিন্তু ইসরায়েল ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, তারা দীর্ঘ সময়ের জন্য গাজায় সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখবে।