তানোরে সংকট দেখিয়ে দ্বিগুণ দামে সার বিক্রি, নীরব কর্তৃপক্ষ

মো: ইমরান হোসাইন; তানোর, রাজশাহী | প্রকাশ: ৩০ আগস্ট, ২০২৫, ০৪:৫৩ পিএম
তানোরে সংকট দেখিয়ে দ্বিগুণ দামে সার বিক্রি, নীরব কর্তৃপক্ষ
রাজশাহীর তানোরে কৃষি বিভাগের যোগসাজশে সার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এমওপি, টিএসপি ও ডিএপি সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সরকার নির্ধারিত দাম থেকে অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করছেন ডিলার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এভাবে সারের অতিরিক্ত দাম নিলেও দেয়া হচ্ছে না কোন রশিদ। কখানো বা দিলেও সেখানে সরকার নির্ধারিত দাম লেখা হচ্ছে না। কেউ এসবের প্রতিবাদ করলে তাকে চাহিদা মতো দেয়া হচ্ছে না সার। একারণে প্রতিবাদ করার কেউ সাহস পাচ্ছে না। এ সুযোগে চৌবাড়িয়া বাজারের জয়নব টেড্রার্স, তালন্দ বাজারের কাজল, গণেশ ও মনিরুল পার্শবর্তী মোহনপুর উপজেলার কেশরহাট, ধুরইল ও মান্দা উপজেলার সাবাইহাট এবং চৌবাড়িয়াহাট থেকে চোরা পথে প্রতিদিন ট্রলি করে টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সার পানির স্রোতের মতো তানোর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেটচক্র। উপজেলা কৃষি সমপ্রসারণ অফিস সূত্র জানা গেছে, খোলা বাজারে এমওপি ১ হাজার টাকা, ডিএপি ১ হাজার ৫০ টাকা, টিএসপি ১ হাজার ৩৫০ টাকা সরকার নির্ধারিত দাম বেঁধে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ডিলাররা সংকট দেখিয়ে দ্বিগুন দামে সব ধরণের সার বিক্রি করছেন। তারা কোথায় পাচ্ছে এসব সার। সার বিপণন নীতিমালা অনুয়ায়ী এক এলাকার সার অন্য এলাকায় বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। শনিবার তানোর সদরের সার ব্যবসায়ী সৈয়ব আলী, প্রণাব সাহা ও তালন্দ বাজারের সুমন ও বাবুর ছেলের দোকানে কৃষক-চাষিদের মধ্যে হট্টগোল, ঠেলাঠেলি ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। তবে, এসব বিক্রিত সারের কোনো ক্রয় রশিদ দেয়া হচ্ছে না। ফলে আসল নকল না নিম্নমাণের ভেজাল সেটা বোঝার ক্ষমতা নেই। আবার এসব সার কিনে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কিছু করার নেই সাধারণ কৃষকের। প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে সরকার অনুমোদিত বিসিআইসি ডিলারগণ এমওপি, টিএসপি ও ডিএপি সার দিতে পারছে না, সেখানে তারা চোরা পথে এসব সার দিচ্ছে কিভাবে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে তানোরে ২৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আমন চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। যা গত বছরের প্রায় সমান। কৃষক ও চাষিদের অভিযোগ, প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে টিএসপি, এমওপি ও ডিএপিসহ বিভিন্ন প্রকার সারের দাম বেশি নেওয়া হলেও ডিলার-ব্যবসায়ীরা কোনো রশিদ (ভাউচার) দিচ্ছেন না। কোন কৃষক রশিদ নিতে আগ্রহ দেখলে তাতে সরকারি মূল্যে লিখে দেয়া হচ্ছে। আর এতে কেউ নিতে রাজি না হলেও তার সার নিয়ে টাকা ফেরৎ দেয়া হচ্ছে। এনিয়ে কোন ভুক্তভোগি মোবাইলে অথবা সরাসরি অভিযোগ দিলেও তাতে ভ্রুপক্ষেপ নেই কৃষি অফিস ও উপজেলা সার মনিটরিং কমিটির নীতি নির্ধারকদের বলে অভিযোগ কৃষকদের। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে গোলো দুই সপ্তার ব্যবধানে রাজশাহীর তানোরে এমওপি (পটাশ) ও টিএসপি সার দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছেন বিএডিসি ও বিসিআইসি ডিলাররা। তবে, এব্যাপারে বিসিআইসি ডিলাররা বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে আমদানিকারক নোয়াপাড়ার ফায়েজ ট্রেডিং কর্তৃপক্ষের ‘সিন্ডিকেট’কে দায়ী করছেন পাঁচন্দর ইউপির মেসার্স প্রাইম ট্রেডার্সের প্রোপাইটার শ্রী প্রণব কুমার শাহ্। পুরো উপজেলায় ৯ জন (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) বিসিআইসি ডিলার নিযুক্ত রয়েছেন। এসব ডিলাররা যশোহর নোয়াপাড়ার আমদানীকারক ফায়েজ ট্রেডিং এর মাধ্যমে সব ধরণের সার পেয়ে থাকেন। কিন্তু নোয়াপাড়ার ফায়েজ ট্রেডিং কর্তৃপক্ষ প্রভাবিত হয়ে কালো টাকার গন্ধে সিরিয়াল অজুহাতে চলতি মাসের শুরু থেকে সবধরণের সার সরবরাহে বিলম্বিত করছেন। ফলে সেখান থেকে চলতি মাসে এটুকু সার পাননি ডিলাররা। এসুযোগে বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) ডিলাররা বরাদ্দের সার নিজেরাই ব্যবহার ও ইচ্ছে মতো বেশি দামে বিক্রি করছেন বলে ভুক্তভোগী কৃষক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আর এমওপি সার ছাড়া সব ধরণের সার এ্যাবুলেবুল পাওয়া যাচ্ছে বলে উপসহকারী কৃষি অফিসাররা (বিএস) দাবি করছেন। এসআর ডিএ ও কৃষি সার্ভিস তথ্যমতে জানা গেছে, পুরো উপজেলার আয়তন ২৯ হাজার ৯০০ হেক্টর। এরমধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমান ২৩ হাজার ৬০০ হেক্টর। বাকি ৬ হাজার ৩০০ হেক্টর নদ-নদী ছাড়াও খাল-বিল, পুকুর-পুষ্কুনি ও বসতি জমি। এবার গেলো রোপা আমন চাষে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি। অর্জন হয় ২২ হাজার ৪৩৯ হেক্টর। তানোর পৌর এলাকার জিওল গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুৃক বেশ কয়েকজন কৃষক বলেন, আলুতে লোকসার করে ধার দেনায় জমিতে আমন ধান রোপণ করেছেন। সারের জন্য তানোর সদরের স্থানীয় সার ব্যবসায়ী মাইনুল ইসলাম, কাশিম বাজারের আব্দুল ও আকতার আলীর কাছে গেছেন। কিন্তু সার নেই বলে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন। উপজেলার পাঁচন্দর ইউপির সার ডিলার প্রণাব সাহার দোকানে সপ্তা ধরে ঘুরেও পাচ্ছেন না কোন ধরণের সার। ফলে প্রায় কৃষকের জমিতে আজও প্রয়োজন মতো সার দিতে পারেননি তারা। একই কথা জানান, জিওল গ্রামের কৃষক ওমর হাজী। তিনি বলেন, প্রতিবারের ন্যায় এবারও শতাধিক বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষাবাদ করেছেন। এসব জমি তার নিজস্ব ও অন্যের বর্গা রয়েছে। কিন্তু ডিলার সিন্ডিকেটে বেশি দামে সব ধরণের সার ক্রয় করতে হচ্ছে। মনে হয় এসব অনিয়মের ব্যাপারে কেউ দেখার নেই। তানোর পৌর এলাকার তালন্দ বাজারের বিসিআইসি সার ডিলার মরহুম মোহাম্মাদ আলী বাবুর নামে রয়েছে। তালন্দ বাজারে অবস্থিত তার ছেলের দোকানে ও বাড়িতে একাধিকবার গেছেন। সেখানে তাঁর গুদাম ঘরে সার দেখছেন। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে তাকে সার না দিয়ে সপ্তা ধরে হয়রানি করা হচ্ছে বলে জানান ওমর হাজী। এনিয়ে উপজেলা কৃষি অফিসে অভিযোগ করেও এখনো কোন সার পাওয়া যায়নি। তবে, এব্যাপারে বাবুর ছেলে ও প্রণাব সাহা বলেন, টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সারের বরাদ্দ কম। আমরা না পেলে কৃষকদের কাছে বিক্রি করব কীভাবে? তবে বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ ব্যাপারে এড়িয়ে গেছেন এই দুই সার ডিলার। এবিষয়ে তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহমেদ বলেন, সরকারিভাবে এবার টিএসপি ও এমওপি সারের বরাদ্দ কমিয়ে ডিএপি সারের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তাতে সারের সংকট হওয়ার কথা নয়। তবে, কৃষকরা না বুঝে টিএসপি সারের প্রতি ঝুঁঁকেছেন। আমরা কৃষকদের টিএসপির বদলে ডিএপি ব্যবহারে উৎসাহিত করছি। নিয়মিত বাজার তদারকি করা হচ্ছে। কোন ডিলার বেশি দামে সার করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ই/তা
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে