মোবারকগঞ্জ চিনিকল চলছে বিপুল লোকসান আর ঋণ নিয়ে

এফএনএস (টিপু সুলতান; কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ) : | প্রকাশ: ৩১ আগস্ট, ২০২৫, ০৬:০৮ পিএম
মোবারকগঞ্জ চিনিকল চলছে বিপুল লোকসান আর ঋণ নিয়ে

কালীগঞ্জে মোবারকগঞ্জ চিনিকল একটি ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান হলেও বর্তমানে এটি চলছে বিপুল লোকসান আর ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে। বিশেষ করে গত ২০২৩-২৪ আখ মাড়াই মৌসুমে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫৪২ টাকা,যেখানে প্রতি কেজিতে লোকসান দিতে হয়েছে ৪১৭ টাকা। চিনিকলটি গত মাড়াই মৌসুমে ৭০ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। চিনির আহরণ ধার্য করেছিল মাত্র ৫.৬%, যা উৎপাদনের জন্য অপ্রতুল।

ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলায় ২০৩.৯৩ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত চিনিকলটি ১৯৬৫ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৯৬৮ সালে সমাপ্ত হয়এবং ১৯৬৭-৬৮ সালে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে।মোবারকগঞ্জ চিনিকল ১৯৬৫ সালে স্থাপিত হয় নেদারল্যান্ডস সরকারের সহায়তায়।কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে মিলটি কোনো আধুনিকায়নের মুখ দেখেনি। ব্রিটিশ আমলের পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় প্রতি বছর বাড়ছে জ্বালানি খরচ এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়।উৎপাদন ব্যয়ের সিংহভাগ যায় কর্মচারীদের বেতন, সরকারের ভ্যাট এবং ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধে।দীর্ঘদিন চিনিকলটি নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চালু রয়েছে।মান্দাতের আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে ও নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে চিনিকলটি চাল ুরয়েছে।

গত মাড়াই মৌসুমে চিনি উৎপাদন হার ছিল অন্য অর্থবছরের থেকে অনেক কম। গত অর্থবছরে ২৫০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্জিত হয় মাত্র ১৮৭১ মেট্রিক টন। এছাড়া মিলটিতে অপারেশনাল লস দেখানো হয়েছে ৩৪ কোটি ও ব্যাংক ঋণের সুদ দেখানো হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৭০ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা আর ৩৫০ কোটি টাকা ব্যাংকের দেনা মাথায় নিয়ে আবার আখ মাড়াই মৌসুম উদ্বোধন করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিকেলে মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি ৫৮তম মাড়াই মৌসুম শুরু করেছি। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহর সংলগ্ন এলাকায় ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যায়ে ২০৭ দশমিক ৯৩ একর নিজস্ব জমির ওপর নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। চিনিকলের আওতাধিন ২০ দশমিক ৬২ একর জমিতে কারখানা,৩৮ দশমিক ২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক কলোনি, ২৩ দশমিক ৯৮ একর পুকুর, ১০৭ একর জমিতে ইক্ষু খামার ও ১৮ দশমিক ১২ একর জমিতে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয় কেন্দ্র।

ঝিনাইদহের ৬ উপজেলা ছাড়া যশোরের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত চিনিকলের ৮টি জোন অফিস নিয়ে ইক্ষু উন্নয়ন,রোপন,ক্রয়,আখ চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া প্রধান কাজ। কিন্তু পরে গিয়ে সবই শেষ হয়ে মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বরত ইক্ষু উন্নয়ন কর্মকতাদের অনিয়ম,দূনিতির কারনে কুষকরা আখ রোপন করতে অনিহা প্রকাশ করে।মোচিকের আওতাধিন কৃষকদের অভিযোগ, মিলের কর্মকর্তা ও সিবিএ নেতাদের লাগামহীন দুর্নীতি, কর্তব্য অবহেলা ও অদক্ষ শ্রমিক কর্মচারিদের কারণে মিলটির ঐতিহ্য হারিয়ে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অতিরিক্ত অদক্ষ জনবল নিয়োগের কারনে চিনিকলটিতে প্রতি বছর বেতন ভাতা বাবদ অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়।

কালীগঞ্জ উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের আমিরুল ইসলাম এবং মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের আখ চাষী আজগার আলী জানান,কৃষক যদি আখ চাষ না করে তাহলে চিনিকলটি চলবে কিভাবে। আখের মূল্য বৃদ্ধি না করলে আমরা আখ চাষ করব না। বর্তমান উচ্চ মূল্যের বাজারে কোন কৃষি উৎপাদিত পণ্য ৬ টাকা কেজি নেই শুধুমাত্র আখ ছাড়া। চিনি সমৃদ্ধ আখের জাত নির্ধারণ করে সেই জাতের আখ চাষের ব্যাপারে কৃষকদের সহায়তা করতে হবে।মোবারকগঞ্জ চিনিকলে ১১৮৪ জন কর্মকর্তা কর্মচারীর পদ থাকলেও বর্তমানে ৬৫৮ জন কর্মরত আছেন।দীর্ঘদিন ধরে দক্ষ জনবল সংকটে ভুগছে চিনিকলঠি।আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১ লাখ ৫০ হাজার ২৩৫ হেক্টর। এই জমির মধ্যে ২০২৪/২৫ মাড়াই মৌসুমে আখ রোপণ হয়েছিল মাত্র ৪ হাজার ৪১০ একর জমিতে।মৌসুমে চিনি উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ধার্যছিল ৩ হাজার ৭৮০ মেট্রিক টন। চিনি উৎপাদন হয়েছিল ৩ হাজার ৮৬৮ মেট্রিক টন। আগামী ২০২৫/২৬ মৌসুমে আখ রোপনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ৪ হাজার ৮০০ একর। আখ মাড়াই কার্যদিবসে ধার্য হয়েছে ৯০ হাজার মেট্রিক টন এবং চিনি উৎপাদন হবে ৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। 

এক সময়ে চিনিকলটি ৬/৭ মাস আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন হত কিন্তু কৃষকরা আখ রোপন না করা কারনে গত মাড়াই মৌসুমে মাত্র ৬৬ দিন মাড়াই কার্যদিবস চালু ছিল। বর্তমানে প্রতিমন আখের মূল্য ২৪০ টাকা। ২০২৩/২৪ অর্থবছরে মোবারকগঞ্জ চিনিকলে ১ প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন করতে খরচ হয় ৩৪৯.৫০ টাকা, বিক্রি হয় ১২৫ টাকা কেজি। যে কারনে ২২৫.৫০ টাকা প্রতি কেজি চিনি বৃদ্ধি হওয়ায় সার্বিক খরচ বেড়ে যাচ্ছে।বর্তমানে মিলটিতে ২৫০০ মেট্রিক টন চিনি, ৪১ মেট্রিক টন চিটা গুড় মজুদ রয়েছে। বিশেষ করে প্রতি বছর আখ মাড়াই শৌসুমের সময় ব্যাপক ভাবে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ থাকে মাড়াই কার্যক্রম। ফলে ক্রয় কেন্দ্র গুলোতে খোলা আকাশের নচেই আখ শুয়ে যায়। এদিকে ২০২২/২৩ মাড়াই মৌসুমে চিনিকলটি ৩৪ কোটি টাকা লোকমান খেয়েছি।

অপরদিকে ২০২০/২১ মাড়াই মৌসুমে ১৬৭ কোটি ৫৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে আয় হয় ৭১ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এই সময়ে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন খরচ পড়ে ঋণের সুদসহ ২০৬ টাকা ৪৮ পয়সা। সেই চিনি বিক্রি করেছিল ৭৫ টাকায়।চিনিকলের আয় ও খরচের হিসাব থেকে জানা যায়, ২০১৬/১৭ অর্থবছরে ৯৪ কোটি ৮৯ লাখ ৯ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে আয় হয় ৫৯ কোটি ২৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা, এই সময়ে ঋণের সুদসহ প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ পড়ে ১৭৫ টাকা ৫৮ পয়সা। ২০১৭/১৮ অর্থবছরে ১০৫ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে আয় হয় ৪১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, এই সময়ে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন খরচ পড়ে ঋণের সুদসহ ১৯২ টাকা ৪৫ পয়সা।২০১৮/১৯ অর্থবছরে ১৩০ কোটি ৪২ লাখ ৫ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে আয় হয় ৩৮ কোটি ৩৩ লাখ ৬২ হাজার টাকা এবং প্রতিকেজি চিনি উৎপাদনে খরচ পড়ে ২১১ টাকা ৯ পয়সা। ২০১৯/২০ অর্থবছরে ১২৭ কোটি ৩ লাখ ৮১ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে আয় হয় ৪০ কোটি ৬৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা এবং প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ পড়ে ১৯৩ টাকা ৫৪ পয়সা।

মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গৌতম কুমার বলেন, নিচু জমিতে উৎপাদিত আখে চিনির উৎপাদন হার কম হয়। তাছাড়া মাড়াই মৌসুম শুরু হলে এক শ্রেনির অসাধু আখচাষি ওজন বৃদ্ধি করতে জমিতে সেচ ও সার প্রয়োগ করেন যে, ফলে চিনি উৎপাদন হার কমে যায়।

বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক ফেডারেশন সভাপতি ও মোচিক শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি শফিকুর রহমান রিঙ্কু বলেন,মোবারকগঞ্জ চিনিকলের সাথে এ অঞ্চলের  অনেক আখ চাষী,শ্রমিক কর্মকর্তার জীবন জীবিকা জড়িত। আটা রক্ষা করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।

মোবারকগঞ্জ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আ.ন.ম জোবায়ের বলেন, ইতিমধ্যে আখের মূল্য বৃদ্ধির জন্য চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনে আবেদন করেছি। মোবারকগঞ্জ চিনিকলঠি লোকসানের কবল থেকে লাভজনক করার জন্য নানা পরিকল্পনা কর্পেরেশনের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। 

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে