স্বাস্থ্যসেবা দেশে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে

এফএনএস এক্সক্লুসিভ | প্রকাশ: ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৮:১৪ এএম
স্বাস্থ্যসেবা দেশে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে

স্বাস্থ্যসেবা দেশে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার থাকলেও স্বাস্থ্যখাতের বৈষম্য সবচেয়ে বড় উঠছে। চিকিৎসকের কাছে গেলেই একাধিক পরীক্ষা দেয়া হয়। প্রতি বছর দেশে চিকিৎসার পেছনে রোগীদের যত অর্থ ব্যয় হয়, তার বড় অংশই রোগ নির্ণয়ে যায়। ওসব রোগ নির্ণয়ের বেশির ভাগই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হওয়ায় অর্থ খরচ হয় সরকারি হাসপাতালের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটই এ তথ্য দিয়েছে। আর ওই অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রধান কারণ বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে চিকিৎসকদের অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে সরকারিভাবে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ার পরও বর্তমানে বেসরকারি চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল দেশের ৮৫ শতাংশ রোগী। আর সরকারি হাসপাতালের ২০-২৫ শতাংশ চিকিৎসক বিশেষ সুবিধা নেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রোগী পাঠিয়ে। ওই কাজে কনসালট্যান্ট, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকরা সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যতো বড় নামকরা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসকদের কমিশন প্রদানের হার তার ততো বেশি। তাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকরা লাভবান হলেও চিকিৎসার উচ্চ ব্যয় মেটাতে প্রতি বছর অন্তত ৬২ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমায় চলে যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, চিকিৎসকরা দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক বা স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত কোম্পানি থেকে বিভিন্ন সুবিধা নেন। ওসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসকদের বাড়ি, গাড়ি, অর্থ ইত্যাদি দিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। পাশাপাশি ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখে উপহার হিসেবে মোবাইল, ফ্রিজ, টিভি, ওভেন, কম্বল, সোফা সেট, ডিনার সেট, শাড়ি, পাঞ্জাবি, গিফট ভাউচার ইত্যাদি দেয়া হয়। যাতে চিকিৎসক তাদের কোম্পানির ওষুধ বা সেবার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং রোগীদের সেসব ওষুধ বা সেবা ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করে। যা এক ধরনের অনৈতিক এবং বেআইনি কার্যকলাপ। আর তা চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও আস্থার অভাব তৈরি করে। দেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর কারণে প্রতি বছর জনসংখ্যার ৩ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়। সংখ্যায় তা অন্তত ৬২ লাখ। মানুষের পকেট থেকে মোট স্বাস্থ্যব্যয়ের ৭৩ শতাংশ অর্থ চলে যাচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ওষুধ এবং পরীক্ষানিরীক্ষার পেছনে খরচ হয়। রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার ফি সরকারি হাসপাতালে কম হলেও বেসরকারি পর্যায়ে তা কয়েকগুণ বেশি। যদিও অধিকাংশ পরীক্ষাই সরকারি হাসপাতালে হয় না।

সূত্র আরো জানায়, বিগত ১৯৯৭ সালে চিকিৎসার পেছনে ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ অর্থ মানুষের পকেট থেকে চলে যেতো। ২০২০ সালে তা বেড়ে ৬৮ শতাংশ হয়েছে এবং সর্বশেষ ২০২১ সালের হিসাবে তা আরো বেড়ে ৭৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় রোগ নির্ণন পরীক্ষা ফি বিভিন্ন হাসপাতালে বিভিন্ন রকম। রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরের এলাকাভেদে ওই মূল্যের তারতম্য দেখা যায়। কোথাও কোথাও একই পরীক্ষার মূল্য ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত পার্থক্য দেখা যায়। তবে করোনা মহামারির সময়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতর চিকিৎসা ব্যয় সাধারণের নাগালে রাখার লক্ষ্যে অতি জরুরি ও প্রয়োজনীয় ১০টি পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। ওই সময়ে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য কিছু সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তবে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতিষ্ঠানের অবস্থান এবং অবকাঠামোগত কারণেও বিভিন্ন পরীক্ষার চার্জ কমবেশি হয়ে থাকে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। তারাই নির্ধারণ করে দেয় কত রেটের নিচে পরীক্ষা করা যাবে না। তবে কত বেশি নেয়া যাবে তা নির্ধারণ করা হয় না। তাছাড়া পরীক্ষার মূল্যের সঙ্গে চিকিৎসকদের একটা কমিশনের বিষয় রয়েছে। সেজন্যই চিকিৎসক রোগীর ব্যবস্থাপত্রে টেস্টের নাম লিখে নির্দিষ্ট ডায়াগনোস্টিক সেন্টার লিখে দেয়। ওই সেন্টারে তার নামে একটি কোড আছে। ওই কোডে যতো টেস্ট করা হবে তার কমিশন ওই চিকিৎসক পাবে। সেজন্যই অনেক রোগী অন্য কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করে নিয়ে এলেও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক অধিকাংশ সময়ে ওই রিপোর্ট গ্রহণ করে না অথবা রোগীকে আবার টেস্ট করাতে বলে। তাতে রোগীর জন্য ডাবল খরচ হয়। সেজন্যই রোগীরা বাধ্য হয়ে ডাক্তারের নির্ধারিত ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে গিয়েই পরীক্ষা করায়।

এদিকে বর্তমান সরকার স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন গঠন করে। ইতোমধ্যে ওই কমিশন সংবিধান সংশোধন করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে দেয়ার সুপারিশ করেছে। রোগী সুরক্ষা, আর্থিক বরাদ্দ, জবাবদিহিতা ও জরুরি প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব আইন পর্যালোচনা ও যুগোপযোগী করার সুপারিশ করেছে কমিশন। স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য সাশ্রয়ী, মানসম্মত এবং সহজলভ্য করতে সব ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয় এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বলেছে কমিশন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে দেশের সব বেসরকারি হাসপাতালে রোগ নির্ণয় পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু দীর্ঘ ১৩ বছর থেকে তা নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা চলছে এবং স্টেকহোল্ডারদের সাথে একাধিক বৈঠক হয়েছে। বর্তমানে আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চূূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় পাস হচ্ছে না আইনটি।

অন্যদিকে পরীক্ষা ফি ও স্বাস্থ্য ব্যয় কমানো এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন পাসের বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান জানান, জনগণকে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাজেটে দেশের জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ ব্যয় করার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ রয়েছে। আর বাংলাদেশের বাস্তবতায় ওই বরাদ্দ মোট বাজেটের ১০ শতাংশে রাখা প্রয়োজন। কারণ এখন ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপে ভোগা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। রোগীর ব্যয় কমাতে রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধে নজর দিতে হবে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে