শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি অবজ্ঞার পরিণতি!

রাজু আহমেদ | প্রকাশ: ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৪:০৭ পিএম
শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি অবজ্ঞার পরিণতি!
রাজু আহমেদ

শিক্ষাকে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যতই দমিয়ে রাখা হোক, নিগৃহীত বা অবমাননা করা হোক-রাষ্ট্রের অবস্থা ততটাই বিপন্ন হয়ে যাবে। শিক্ষকদের প্রতি যত অসম্মান, অবহেলা বা অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হবে, শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ববোধ ও আত্মমর্যাদা ততখানিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মনে রাখতে হবে, এই শিক্ষার্থীদের ভেতর আমাদের সন্তানরাও রয়েছে। শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করে যদি কেউ আনন্দ পান, শিক্ষাকে অবহেলা করে যদি কেউ পুলক অনুভব করেন-তবে এর ভয়াবহ পরিণতি আল্লাহই ভালো জানেন।

বাংলাদেশ শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করে কোথায় যেতে চায়? শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য আজও নির্ধারিত হয়নি। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও শিক্ষা ও গবেষণার জন্য যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত হয়নি। প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়নি শিক্ষা, শিক্ষকতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে; বরং অপদস্থ করার আয়োজন বেড়েছে বহুগুণে। শিক্ষকদের শত্রু ভেবে ভুল করছেন অনেকে। শিক্ষা হয়ত অর্থ দিয়ে কেনা যায়, কিন্তু সভ্যতা, সততা ও সত্যবাদিতা আজও শিক্ষকের হাতেই শেখা হয়। যারা অভিভাবক হিসেবে শুধুই সম্পদ মূল্যায়ন করেন, তারা সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন না। শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণির মানুষ মনে করে সন্তানদের কাছ থেকে ঠাকুর সম মর্যাদা প্রত্যাশা নিছক ভ্রম।

শিক্ষা ও শিক্ষকের সঙ্গে অনেকের অঘোষিত শত্রুতা দেখা যায়। এই প্রবণতা জাতির জন্য মারাত্মক ও বিধ্বংসী। শিক্ষকদের হেয়, অপমান বা অবহেলা করলে কোন লাভ নেই। শিক্ষক যতটুকু সভ্যতা শিক্ষার্থীদের দিতে পারেন, সমাজ, সংসার ও রাষ্ট্রও ততটুকুই সহায় হতে পারে। শিক্ষক যদি যেকোনো স্বার্থপর ব্যবস্থার উপাদানে পরিণত হন, তবে জাতির ভবিষ্যৎ নিদারুণ দুঃখের মধ্য দিয়ে যাবে। শিক্ষকের জ্ঞান, দৃষ্টি, দোয়া ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে সন্তান প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে; সেখানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুঠারাঘাত করা।

কিছু মানুষের বিমাতাসুলভ আচরণ শিক্ষকের হৃদয় ব্যথিত করে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা যখন শিক্ষকের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন, তখন ধ্বংসের সাইরেন নিজে থেকেই বাজতে থাকে। শিক্ষকের সঙ্গে শত্রুতার প্রশ্ন কি জ্ঞান বা জানার বিতর্কে? কেন তাদের ন্যূনতম অধিকার আদায়ে আন্দোলন করতে হয়, মর্যাদা রক্ষার জন্য পথে দাঁড়াতে হয়, পদোন্নতি ও পদায়নের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়? শিক্ষক শুধু নির্বিঘ্নে পাঠদান করতে চান। খুঁচিয়ে, স্বার্থে আঘাত করে বা মানসিকভাবে বিপন্ন করলে কারও কোনো লাভ নেই। রাষ্ট্রের মঙ্গল ও সমৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদের মর্যাদাপূর্ণ স্থানে রাখা অপরিহার্য। শিক্ষার্থীদের যথাযথ সুযোগ না দিলে রাষ্ট্র বারবার অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার মুখোমুখি হবে। একদিন শত্রুরা নিপাত হলে নিজেদের ভেতরেই সংঘাত শুরু হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে সুনজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক, নেই উপযুক্ত শ্রেণিকক্ষ, নেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। এই দশা কাটাতে প্রয়োজন সৎ উদ্যোগ ও দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সুশিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার আন্তরিকতা জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লোক দেখানো উদ্যোগ হলেও শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা যেত। শিক্ষা খাতকে অবহেলায় রেখে রাষ্ট্রের অন্য কোনো সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়। শিক্ষার ফল তৎক্ষণাৎ প্রকাশ পায় না; সুশিক্ষার সুফল বা কুশিক্ষার ক্ষতি দেখতে এক দশকেরও বেশি সময় লাগে। শিক্ষায় সাময়িক সমাধান নেই; সমাধান মানেই স্থায়ী পথ খোঁজা। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার ধারা গতানুগতিক রয়ে গেছে। জোর করে কিছু চাপালে কেবল বদহজম বাড়বে, আর তা জাতীয় বিপর্যয় ডেকে আনবে।

রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জনতার করের টাকায় বেতন পাওয়া সেবকের সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো না হলে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র ও চরিত্র স্পষ্ট হবে না। সব দায় শিক্ষকের ওপর চাপিয়ে দায়সারা দায়িত্ব পালন করে কোনো লাভ নেই। সিস্টেমের গলদ ও কর্তাদের আন্তরিকতা ছাড়া দিনবদল সম্ভব নয়। শিক্ষকরা সবাই সাধু নন, তবে যত সৎ ও যোগ্য মানুষ শিক্ষায় আছেন, রাষ্ট্র যদি তাদের যথাযথ দিকনির্দেশনা দেয়, যুগান্তকারী পরিবর্তন সম্ভব।

মানুষ গড়ার এই মহৎ কারখানায় যেন কারো কু-দৃষ্টি বা কালো ছায়া না পড়ে, সে দিকে লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সচেতন ও সজাগ থাকা প্রয়োজন। সরকারিভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নইলে সমাজে আলোকিত মানুষের সংখ্যা ক্রমে কমবে। স্বার্থপরতা, অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও অসততা প্রতিদিন বাড়বে। সংঘাত ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে সমাজ অস্তিত্ব হারাবে। সামনে আসবে অস্থির সময়। আজ প্রশ্ন একটাই-রাষ্ট্র কি এই অধঃপতনের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে লড়াই করবে, নাকি চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবকিছু ধ্বংস হতে দেখবে?

লেখক: রাজু আহমেদ; প্রাবন্ধিক