বছরের পর বছর পরিবার থেকে দূরে দায়িত্ব পালন করা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বদলির সার্কুলারে আশার আলো দেখেছিলেন। কিন্তু অনলাইনে আবেদন করতে গিয়ে দেখা যায়, কাগজে শূন্য পদ দেখানো হলেও সফটওয়্যারে সেসব পদ ব্লক করে রাখা হয়েছে। দেশের অন্তত ১১৪ উপজেলায় এ ধরনের কারসাজির অভিযোগ উঠেছে উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী শিক্ষকদের দাবী এটি প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা নয়, বরং ইচ্ছাকৃত প্রহসন! ফলে স্বামী/স্ত্রীর ঠিকানায় নতুন করে বদলী চালুর দাবী জানান তাঁরা।
সর্বশেষ ২১ জুলাই প্রকাশিত সার্কুলারে বলা হয়, স্বামী/স্ত্রীর স্থায়ী ঠিকানায় ২৩ জুলাই থেকে ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে শিক্ষকরা অনলাইনে বদলীর আবেদন করার সুযোগ দেয়া হয়। বোয়ালমারীর এক শিক্ষক বলেন, বহুদিন স্ত্রী তার পিতার ঠিকানায় চাকরি করছেন, সম্প্রতি বদলী চালু হলেও আমার উপজেলায় অনেক পদ হোল্ড করা ছিল বিধায় আবেদনই করা হয়নি। অথচ কাগজে শূন্য পদ ছিল। ফরিদপুরের আরেক শিক্ষক অভিযোগ করেন, তাঁর স্কুলে মাত্র একজন শিক্ষক আছেন, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তবুও বদলীর আবেদন করলে কোনো শিক্ষক আসতে পারছেন না। কারণ তালিকায় শূন্য পদ দেখালেও অনলাইনে আবেদন করা যায় না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে. অনলাইনে বদলী চালুর পর দেশের অন্তত ১১৪ উপজেলা শিক্ষা অফিসার বদলীর শূন্য পদ সফটওয়্যারে হোল্ড করে রেখেছিলেন। ডিপিইর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের হাতে তথ্য আছে। অনেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার ইচ্ছাকৃতভাবে পদ হোল্ড করে রেখেছিলেন। এজন্যই জেলা শিক্ষা অফিসারদের কাছে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ পাঠানো হয়েছে।”
অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের অনেকে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা দাবি করেছেন, সফটওয়্যার অনেক সময় সঠিকভাবে কাজ হয় না, এজন্য আবেদন করা যায় না।
উত্তর দুলাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মোছাঃ সাবানা আক্তার দীর্ঘদিন সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধায় কর্মরত আছেন। স্বামীর বাসা রংপুরে হওয়ায় বহু প্রতিক্ষার পর প্রতিস্থাপন বদলী আদেশ পেয়েছেন। দুই মেয়ে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকা, দৈনন্দিন যাতায়াত এবং চিকিৎসার খরচের কারণে পরিবারটি চরম কষ্টে আছে। তিনি বলেন, “আমরা অসুস্থ, স্বামী একা থাকে। এই অবস্থায় আমাদের একসাথে থাকা জরুরি। আশা করি কর্তৃপক্ষ ২০২৩ এর মতো মানবিকভাবে ব্যবস্থা নেবে।
অনুসন্থানে দেখা গেছে, বদলীর সাকুর্লারে শূণ্যপদের বিপরীতে অনেক পদই হোল্ড করে রাখা হয়। এর মধ্যে সহকারী শিক্ষক পদে জয়পুর হাট সদরে ৫৮ পদের মধ্যে ৪২টি, খুলনা সদরে ৫৩ টির বিপরীতে ৪৫টি, করিমগঞ্জ ৬৭টির মধ্যে ৫০টি, গাজীপুর সদরে ৬৬টির মধ্যে ৫৩টি, বেলাবো ২৬টির বিপরীতে ২৩টি, নরসিংদী সদরের ৮০টির মধ্যে ৬৩টি, ঢাকা ধামরাই ৭৬টির বিপরীতে ৬৪টি, গোপালগঞ্জ কাশিয়ানী ৯৯টির বিপরীতে ৮২টি, ফরিদপুর ভাঙ্গা ৬৯টির মধ্যে ২৫টি হোল্ড করে রাখা হয়। একই অবস্থা প্রধান শিক্ষকপদও, চট্টগ্রাম পটিয়ায় ৬০টির মধ্যে ৪৭টি, ব্রাক্ষনবাড়িয়া নবীনগর ৯০টির মধ্যে ৪৪টি।
অনুসন্ধান বলছে, ১১৪ টি উপজেলায় সাড়ে ৭ হাজার শূণ্যপদের বিপরীতে ২ হাজার ৬ শতাধিক এবং প্রধান শিক্ষকের ৫ সহস্রাধিক শূণ্য পদের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার পদই হোল্ড করে শিক্ষা কর্মকর্তারা।
সরকার বদলেছে, নীতিমালাও একাধিকবার পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের কারসাজি থেকে শিক্ষক বদলী প্রক্রিয়া মুক্ত হয়নি। শিক্ষকরা বলছেন, এর ফলে শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবনে নয়, শিক্ষার্থীদেরও বড় ক্ষতি হচ্ছে। কারণ যেসব স্কুলে শিক্ষক নেই, সেখানে শূন্য পদ ব্লক করে রাখায় নতুন কেউ বদলী হয়ে যেতে পারছেন না।
নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার বলরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১৭ সাল থেকে কর্মরত সহকারী শিক্ষিকা মন্টি রানী জানান, স্বামীর বাড়ী বারহাট্টা উপজেলায় হলেও দীর্ঘদিন ধরে বদলি হতে পারছি না। দুই সন্তান নিয়ে চরম কষ্টে জীবনযাপন করছি। মন্টি রানীর অভিযোগ, কাংখিত উপজেলায় ২৬টি পদ থাকলেও মাত্র একটি শূন্যপদ দেখানো হয়েছে, যার কারণে স্বামীর ঠিকানায় বদলি হতে পারিনি।
ফরিদপুরের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানালেন, তাঁর স্কুলে ৪ জন শিক্ষক থাকার কথা, কিন্তু আছেন মাত্র একজন। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অথচ প্রতিবার বদলীর আবেদন করলেও নতুন শিক্ষক আসতে পারছেন না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এভাবে যদি শূন্য পদ আটকে রাখা হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের অপরাধ কী? সার্কুলার তো কেবল কাগজে থেকে যাচ্ছে।”
বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানা মাঠ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোছা: রওশন আরা পারভীন বলেন, ২০১৬ সাল থেকে কর্মরত আছি। পিতার ঠিকানায় থেকে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করি, ঝুকিপূর্ন রাস্তা। স্বামীর বাড়ী ২৫০ কিলোমিটার দুরে। ৮ বছর যাবত বদলীর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। সম্প্রতি অনলাইনে বদলী চালু হলেও শূণ্যপদ ব্লক রাখায় আমি আবেদন করতে পারিনি। একদিকে স্বামী-সন্তান রেখে পিতার বাড়ীতে বসবাস করছি, অন্যদিকে কর্মরত বিদ্যালয়টি যাতায়াতও চরম কষ্টের।
মোহনগঞ্জ উপজেলার পুঁটিউগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে পিতার ঠিকানায় কর্মরত আছেন সহকারী শিক্ষিকা লিপি রানী সরকার। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমার স্বামীর ঠিকানা বারহাট্টা উপজেলায়। সেখানে কাগজে-কলমে শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও উপজেলা প্রাথমিক কর্মকর্তার কারসাজির কারণে বদলির জন্য আবেদনই করতে পারিনি।”
এ অবস্থায় বড় প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে ডিপিই যে ১১৪ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সত্যিই কি কার্যকর ব্যবস্থা নেবে? ব্যবস্থা নিলে শিক্ষকদেরই লাভ কি? শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা বলছে, এ ধরনের নির্দেশনা অতীতেও এসেছে, কিন্তু মাঠপর্যায়ে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। শিক্ষকরা বলছেন, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া মূখ্য বিষয় নয়, আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য বদলীর আবেদন সুযোগ দেয়া হোক।
১০ম গ্রেড বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদের সমন্বয়ক মু. মাহবুবুর রহমান বলেন, সম্প্রতি স্বামী বা স্ত্রীর ঠিকানায় বদলীতে শূন্য পদ হোল্ড রাখার ঘটনা ঘটেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি উল্লেখ করেন, প্রতিস্থাপন বদলী আদেশ পাওয়া সত্ত্বেও অনেক শিক্ষক এখনও কাঙ্ক্ষিত কর্মস্থলে যেতে পারছেন না। তাই ২০২৩ সালের মতো প্রতিস্থাপন বদলী শিক্ষকদের সমস্যা সমাধান এবং পদ হোল্ড থাকা উপজেলাগুলোর জন্য নতুন করে বদলী কার্যক্রম চালু করা হোক।
ভাংগা উপজেলা শিক্ষা অফিসার বলেন, যেসব পদ হোল্ড করা ছিল তার বিপরীতে মামলা রয়েছে। হয়তো অধিদপ্তরের কাছে তথ্য ছিল না। কারণ দর্শানোর জবাব দেয়া হয়েছে।
রাজশাহী জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. হারুন অর রশিদ অভিযোগ করে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষাখাতে বদলীতে হযবরল অবস্থা চলছে। এখানে কতিপয় কর্মকর্তার কারসাজির ফল শিক্ষকদের ভোগ করতে হচ্ছে। অনেকেই স্বামী/স্ত্রীর ঠিকানায় আবেদন করতে পারে নাই পোস্ট ব্লক থাকার কারণে। অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটও রয়েছে। কিন্তু কিছু বিদ্যালয়ে কারসাজির ফলে পোস্টের তুলনায় ২/৩ জন শিক্ষকও বেশি যোগদান করেছেন।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কাহালগাঁও দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহবুবা নার্গিস বলেন, ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে এখানে কর্মরত। স্বামীর বাড়ী প্রায় ১৫০ কিমি দূরে। দুই সন্তান নিয়ে অসুস্থ বাবা-মায়ের দেখাশোনা করছি। সাত বছর ধরে বদলি না হওয়ায় মানসিক কষ্টে আছি, সামাজিকভাবে বুলিংও হচ্ছে। অনলাইন বদলিতে আশার খোঁজ ছিল, কিন্তু স্বামীর উপজেলায় নিকটবর্তী পদটি ব্লক ছিল, অথচ সেখানে ৪০টি পদ শুন্য। একই বদলিতে অন্যরা বদলি হতে পারলেও আমি পারিনি। আমি ডিজিটাল কারসাজির শিকার! আমার দোষ কোথায়? আশা করি কর্তৃপক্ষ আমাদের মতো ভুক্তভোগীদের পুনরায় সুযোগ দেবেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন বিভাগ) এ.কে.মোহম্মদ সামছুল আহসান দেশ রুপান্তরকে বলেন, যারা অনলাইন বদলীর শূণ্যপদ হোল্ড করে রেখেছিল তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। যা চলমান রয়েছে। এরই মধ্যে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারদের মাধ্যমে কারণ দর্শানো হয়েছে, কিছু কিছু জবাব এসেছে। হোল্ড করার পর বিষয়টি জেনে আমরা আনহোল্ড করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।