একের পর এক অর্থবছর কোনো কাজ ছাড়াই পার করে দিচ্ছে শতাধিক প্রকল্প। অনেক ক্ষেত্রে দশক পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের কাজ হয় না। এমনকি যুগ পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য থাকার নজিরও রয়েছে। উন্নয়নের নামে প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায়। আর তা প্রকল্প প্রণয়ন থেকে অনুমোদন পর্যন্তই প্রবলভাবে থাকে। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে আর তেমন দেখা যায় না। আর ওই কারণেই কোনো কাজ ছাড়াই শত শত প্রকল্প একের পর এক অর্থবছর পার করে দিচ্ছে। কেবল ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই তেমন ১২১টি উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। সেগুলোতে কর্মীদের বেতন ও অফিস খরচ বাবদ অর্থ ব্যয় করা ছাড়া কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ওসব প্রকল্প শূন্য অগ্রগতি নিয়ে বোঝা বাড়াচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২১ প্রকল্পের শূন্য ভৌত অগ্রগতির পাশাপাশি ৮৯টি প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি শূন্য। এডিপি বাস্তবায়নে যা হতাশাব্যঞ্জক। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ওই অর্থবছরের মোট ১ হাজার ৬৫৯টি প্রকল্প ছিলো। কিন্তু অর্থবছর শেষে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি বেশিরভাগ প্রকল্পই। এডিপিতে থাকা মোট প্রকল্পের মধ্যে প্রায় ৩০০টির ভৌত অগ্রগতি ৫০ শতাংশের কম। আর ৬১টি প্রকল্পের অগ্রগতি ২৫ শতাংশেরও কম। তাছাড়া ১২১টি প্রকল্প রীতিমতো শূন্য অগ্রগতি নিয়েই অর্থবছর পার করেছে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ না হলেও কর্মীদের বেতন ও অফিস ব্যবস্থাপনা এবং ভাড়া করা গাড়ির খরচ বাবদ অর্থ খরচ হয়েছে।
সূত্র জানায়, শূন্য অগ্রগতির তালিকায় থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে এক দশকেও কোনো কাজ হয়নি ১৩টিতে। আর ৫ থেকে ১০ বছর ধরে শূন্য অগ্রগতি নিয়ে ৪০টি প্রকল্প ঝুলে রয়েছে। বাকি ৬৮টি প্রকল্প ১ থেকে ৫ বছর ধরে শূন্য অগ্রগতি নিয়েই রয়েছে। তাছাড়া ওই তালিকায় দুই দশক ধরে ঝুলে থাকার প্রকল্পের নজিরও রয়েছে। শুধু শূন্য অগ্রগতি নয়, এমন প্রকল্পের সংখ্যাও কম নয় যেগুলো পুরো অর্থবছরের এক টাকাও খরচ করতে পারেনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপিতে থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৮৯টি প্রকল্পে বরাদ্দের এক টাকাও খরচ হয়নি। অথচ ওসব প্রকল্পের জন্য ওই অর্থবছরে ২ হাজার ৬২৩ কোটি ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিলো। আর ৮৩টি প্রকল্পে ২৫ শতাংশের কম খরচ হয়েছে। ২৮৮টি প্রকল্পে বরাদ্দের ৫০ শতাংশের নিচে খরচ হয়েছে। ১৭৬টি প্রকল্পে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ অর্থ খরচ হয়েছে। মোট ২৯২টি প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় এবং ১৭২টি প্রকল্পের অবস্থা হাতাশাব্যঞ্জক। আর ১৯৩টি প্রকল্পের অগ্রগতি মোটামুটি সন্তোষজনক।
সূত্র আরো জানায়, গুলশান, বারিধারা, বনানী লেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ ২০১০ সালে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ১৫ বছরেও কোনো কাজ করতে পারেনি। ১০ বছর ধরে আইন ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অধস্তন বিচার বিভাগ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ শীর্ষক প্রকল্পটি কাজ ছাড়াই ঝুলে আছে। আইন ও বিচার বিভাগের ২০১৬-২০২৩ মেয়াদে এ প্রকল্পটি বাস্তবানের কথা ছিলো। কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও প্রায় এক দশকেও ওই প্রকল্পের কোনো কাজ হয়নি। এমনকি বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা কোনো অর্থ খরচ করতে পারেনি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের একটি প্রকল্প ২০১৫ সালে অনুমোদন পেলেও এক দশকেও কোনো কাজ হয়নি। রংপুরের ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটির ২০২১ সাল পর্যন্ত মেয়াদ থাকলেও কোনো কাজ ছাড়াই দশক ধরে এডিপিতে ঝুলে রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই বাজারের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস শীর্ষক প্রকল্প ১০ বছর ধরে কাজ ছাড়াই শূন্য অগ্রগতিতে রয়েছে। জাতীয় উৎপাদনশীলতা সংস্থা এবং পেটেন্ট নকশা ও ট্রেডমার্ক বিভাগের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজও ঝুলে রয়েছে ১০ বছর ধরে। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের ঢাকা সমন্বিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা শীর্ষক প্রকল্পটির অনুমোদনের ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও কাজ শুরু হয়নি। ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে কারাগার নিরাপত্তার আধুনিকীকরণ প্রকল্পটির কাজও এক দশকে শুরু হয়নি। তাছাড়াও ওই তালিকায় রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের একটি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প।
এদিকে বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে রয়েছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের প্রকল্প। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের তিনটি প্রকল্প শূন্য অগ্রগতি নিয়ে ঝুলে রয়েছে ১০ থেকে ১৩ বছর। তার মধ্যে ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলায় উন্নয়ন আবাসিক প্লট নির্মাণ প্রকল্প ১৩ বছর ধরে কোনো কাজ ছাড়াই ঝুলে আছে। আর এক দশক ধরে ঝুলে রয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য আবাসিক এবং বাণিজ্যিক প্লট সাইট ও পরিষেবা উন্নয়ন প্রকল্প। তাছাড়া কুষ্টিয়ায় আবাসিক এলাকায় আবাসিক প্লট ও পরিষেবার উন্নয়ন প্রকল্পটির অবস্থাও একই রকম। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ওই প্রকল্পটি ২০১৫ সালে বাস্তবায়ন শুরুর কথা থাকলেও এখনো কোনো কাজ হয়নি। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্পটিও ৫ বছরের অধিক সময় ধরে ঝুলে রয়েছে কোনো কাজ ছাড়াই।
অন্যদিকে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩২৫টি প্রকল্প সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ৩০৩টি শেষ হয়েছে। তবে তার অনেকগুলোর আবার শতভাগ কাজ না করেই শেষ করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সমাপ্তির তালিকায় থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে মাত্র ১৭৪টির শতভাগ কাজ শেষ করা হয়েছে। বাকি ১২৯টি প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ না করেই সমাপ্ত করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশেরও কম কাজ করেই শেষ করা হয়েছে। তাছাড়া শেষ হওয়া ২৪টি প্রকল্প নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি।
অন্যদিকে পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্টদের মতে, কোনো কাজ ছাড়াই প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকা এডিপি এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জন্য বোঝা। বছরের পর বছর ধরে কেন অগ্রগতি শূন্য অবস্থায় থাকার বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকদের জবাবদিহি প্রয়োজন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ও দায় এড়াতে পারে না। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল দায়দায়িত্ব হচ্ছে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের।