গাজায় শিশু হত্যা, লজ্জিত বিশ্ব মানবতা

মো: শামীম মিয়া | প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৪:০৩ পিএম
গাজায় শিশু হত্যা, লজ্জিত বিশ্ব মানবতা

মানবসভ্যতার ইতিহাসে যত রক্তপাত, যত অমানবিকতা, যত ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনি লেখা আছে-তার ভেতরে গাজার শিশুদের রক্তাক্ত মৃত্যু এক ভয়ালতম দৃষ্টান্ত হয়ে স্থান করে নিয়েছে। শৈশব পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা নিষ্পাপ, পবিত্র ও আশাবহ পর্ব। অথচ সেই শৈশব আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ধূসর গাজার আকাশতলে। বিস্ফোরণের শব্দে যেখানে হাজারও প্রাণ নিভে গেছে, সেখানে এখন শিশুদের কান্না আর মৃত্যুর আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এ এক চরম ট্র্যাজেডি, যা মানবতার আত্মপরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করছে প্রতিক্ষণে। গাজায় চলমান যুদ্ধের যে ভয়াল অভিঘাত, তার সবচেয়ে অসহায় শিকার শিশুরা। জন্মমাত্রই যাদের কাঁধে কোনো রাজনৈতিক দায়ভার নেই, যাদের হাত বারুদ ছোঁয়নি, যাদের চোখ ভবিষ্যতের স্বপ্নে উজ্জ্বল থাকার কথা-তারাই আজ পুড়ে যাচ্ছে অগ্নিগর্ভ বিস্ফোরণে। ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে তাদের রক্তমাখা শরীর। গলে যাওয়া মুখাবয়ব, বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা ধুলোবালি আর রক্তের মিশ্রণে আচ্ছাদিত দেহ-এগুলো কেবল একটি জাতির নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য লজ্জাজনক কলঙ্কচিহ্ন। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে শিশু হত্যার এই নির্মমতা অনেকটা পরিকল্পিত নীরবতায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। যারা নিজেদের সভ্যতার ধ্বজাধারী দাবি করে, তারাই রক্তক্ষয়ী হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দিতে ব্যস্ত। আন্তর্জাতিক আইন, জেনেভা কনভেনশন, শিশু অধিকার সনদ-সবকিছু যেন নিছক কাগুজে নথি। যেসব সংস্থা মানবাধিকার রক্ষার নামে কোটি কোটি অর্থ ব্যয় করে, সেসব প্রতিষ্ঠান আজ নিঃশব্দ দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। জাতিসংঘের বিবৃতিগুলো বারবার প্রমাণ করেছে-তাদের প্রস্তাব, আহ্বান কিংবা নিন্দা কেবল আনুষ্ঠানিকতার খোলস; কার্যকর প্রয়োগের ক্ষমতা কিংবা সদিচ্ছা দুটোই অনুপস্থিত। মানবতা আজ দ্বিধান্বিত, বিক্ষত ও কলঙ্কিত। প্রশ্ন জাগে-এই মানবতা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? প্রতিটি শিশু হত্যার মাধ্যমে কি আমরা সভ্যতার মিথ্যে মুখোশকে আরও নগ্ন করে দিচ্ছি না? বৈশ্বিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো যে স্বার্থপর কূটনৈতিক খেলা খেলছে, তার মাশুল দিচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা। যে শিশুদের পৃথিবী ভরসা করে আগামী দিনের নেতা, বিজ্ঞানী, শিল্পী বা স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল, তারা আজ মাটিচাপা পড়ছে গুলির ঝাঁঝরা বুকে, ধ্বংসস্তূপের নিচে। ইতিহাসে আমরা দেখেছি-হিরোশিমা ও নাগাসাকির শিশুদের বিকলাঙ্গ দেহ মানবতার কলঙ্ক হয়ে রয়ে গেছে। ভিয়েতনামের আগুনে পোড়া শিশু মানবসভ্যতার বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। বসনিয়া, রোয়ান্ডা, সিরিয়া কিংবা ইরাকে নিহত শিশুদের জন্য পৃথিবী চোখের জল ফেলেছিল। কিন্তু গাজার শিশুদের জন্য সেই চোখের জলও যেন শুকিয়ে গেছে। সংবাদপত্রের ছবি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভিডিও কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীর আর্তনাদ-সবকিছুই কেবল কয়েক মুহূর্তের আবেগ জাগিয়ে আবার বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রতিটি শিশুর মৃত্যু একেকটি সভ্যতার মৃত্যু। প্রতিটি নিষ্পাপ মুখ নিভে যাওয়া মানে আগামী দিনের আলোকবর্তিকা নিভে যাওয়া। গাজার এই হত্যাযজ্ঞ কেবল রাজনৈতিক সংঘাত নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক নৈতিকতার দেউলিয়াত্বের নগ্ন স্বাক্ষর। বিশ্বসভ্যতার স্থপতিরা যখন অর্থনীতি ও সামরিক আধিপত্য নিয়ে ব্যস্ত, তখন মানবিকতার অবলুপ্তি ঘটছে রক্তক্ষয়ী গণহত্যায়। যেসব রাষ্ট্র নিজেদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর স্বাধীনতার পৃষ্ঠপোষক দাবি করে, তারাই আবার শিশু হত্যার নৃশংসতাকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিচ্ছে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে। এ এক ভয়াবহ ভণ্ডামি, যা ভবিষ্যতে গোটা পৃথিবীকে অনিবার্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও শিশু হত্যার এই অমানবিকতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোরআন, বাইবেল কিংবা তওরাতে শিশুদের নিরাপত্তা, করুণা ও সুরক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। নবী-রাসূলগণ শিশুদের প্রতি স্নেহ ও মানবিক দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দিয়েছেন। অথচ আজ ধর্মের নামে যুদ্ধ ঘোষণা করে তারাই নিষ্পাপ শিশুদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। এটি কেবল ধর্মীয় নৈতিকতার পরিপন্থি নয়, বরং ঈশ্বরপ্রদত্ত মানবতারও চরম অবমাননা। গাজার শিশুদের মৃত্যুতে শুধু ফিলিস্তিন নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বই বিব্রত। অথচ রাজনৈতিক বিভাজন, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ আর আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের কারণে মুসলিম দেশগুলোও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কিছু দেশ কেবল আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ থেকেছে, আবার কেউ কেউ নীরব সমর্থন দিচ্ছে। ফলে গাজার মায়ের বুকফাটা কান্না আঞ্চলিক রাজনীতির ঠান্ডা দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়েও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো-মানবজাতির সামনে মুক্তির পথ কোথায়? প্রথমত, শিশু হত্যার বিরুদ্ধে একটি সর্বজনীন নৈতিক অবস্থান গড়ে তুলতে হবে। কেবল নিন্দা নয়, কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে বাধ্যবাধকতা আনতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় না আনলে এই হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত থাকবে। তৃতীয়ত, মিডিয়ার ভূমিকা হতে হবে নিরপেক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ। রাজনৈতিক চাপ কিংবা অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে সংবাদ বিকৃত হলে মানবতার প্রতি দায় অস্বীকার করা হয়। সবচেয়ে জরুরি হলো, আমাদের নিজেদের মানবিক চেতনা জাগিয়ে তোলা। একটি শিশু নিহত হওয়ার খবরকে আমরা যত সহজে স্ক্রল করে পাশ কাটিয়ে যাই, ততটাই আমাদের হৃদয়ের কঠোরতা বেড়ে যায়। আমাদের সন্তান যখন স্কুলব্যাগ কাঁধে নিয়ে নির্ভয়ে বিদ্যালয়ে যায়, তখন গাজার শিশু একই বয়সে লাশ হয়ে কবরের দিকে যাচ্ছে-এই তুলনা আমাদের বিবেককে আঘাত করলেও আমরা নির্লিপ্ত থাকি। এই নির্লিপ্ততাই মানবতার সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হওয়া একটি শিশুর নিথর শরীর যেন সমগ্র পৃথিবীর কাছে প্রশ্ন রেখে যায়-“আমার অপরাধ কী ছিল?”সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হলে মানবসভ্যতার কোনো অর্জনই অর্থপূর্ণ হবে না। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি কিংবা সামরিক শক্তি দিয়ে মানবতা মাপা যায় না; মাপা যায় শিশুদের হাসি, তাদের নিরাপত্তা, তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার মাধ্যমে। যদি সেই নিশ্চয়তা দিতে না পারি, তবে আমাদের সভ্যতা আসলে সভ্য নয়, বরং এক নিষ্ঠুর অমানবিক প্রহসন। গাজার শিশু হত্যার এই নৃশংসতা আজ সমগ্র মানবতাকে লজ্জিত করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সত্যিকার অর্থে শিশুদের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত মানবজাতি কখনো নিজেকে সভ্য দাবি করার নৈতিক অধিকার রাখে না। প্রতিটি শিশু হত্যার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের নিজেদের মানবিক আত্মাকে হত্যা করছি। আজ প্রয়োজন একটি বিশ্বজনীন জাগরণ, যেখানে ধর্ম, জাতি, ভাষা ও ভূগোলের উর্ধ্বে উঠে মানবতার পতাকা উড়বে। নতুবা আগামী প্রজন্ম ইতিহাসের কফিনে লিখে দেবে-“এই সভ্যতা শিশু হত্যার কলঙ্কে চিরকাল লজ্জিত।”

লেখক: মো: শামীম মিয়া; কলামিস্ট