দেশের জল ও স্থল সীমান্ত নজরদারিতে ব্যবহার করা হবে আধুনিক প্রযুক্তি। ওই লক্ষ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নজরদারি রাডার, ড্রোন ও থার্মাল ক্যামেরা যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে মাদক, অস্ত্র, চোরাচালান, মানব পাচার, বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত এবং জলসীমায় এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নজরদারি ও নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পাশাপাশি জোরদার করা হয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ জলসীমায় এবং সীমান্তজুড়ে টহল। ফলে এক মাসে সাগরপথে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের উদ্দেশ্যে বন্দি করে রাখা নারী ও শিশুসহ দু’শতাধিক লোককে উদ্ধার করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ মাদক, অস্ত্র ও গোলাবরুদ উদ্ধার করা হয়েছে আর ২০ পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাছাড়া উদ্ধার হয়েছে প্রতিবেশী দেশে পাচারের উদ্দেশ্যে বহন করা কয়েক কোটি টাকার ডাল, রসুন, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন মালামালও। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদের ৩৩ কিলোমিটার ও শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্রপথের জলসীমার ২০ কিলোমিটারজুড়ে নজরদারির জন্য অত্যাধুনিক ৬টি সার্ভিলেন্স রাডার বসানো হয়েছে। ওই রাডারের মাধ্যমে দীর্ঘ পাঁচ কি.মি. এলাকায় যে কোনো ধরনের বস্তুর উপস্থিতি ও গতিবিধি সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। তাছাড়া নাফ নদের জেটিতেও সার্ভিলেন্স রাডার বসানো হয়েছে। ওসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো কিছু প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব হবে। ফলে সীমান্ত এবং সমুদ্রের জলসীমায় কোনো ধরনের অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ আর থাকবে না। ইতোমধ্যে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন অবৈধ উপায়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক ও ভারি অস্ত্রের চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। একই সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে জেলেবেশে ট্রলারযোগে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটছে। প্রায় সময়ই বিজিবি, কোস্ট গার্ড, এমনকি নৌবাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ছে অস্ত্র, মাদকের চালান আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা। এমন পরিস্থিতিতে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও অস্ত্র, মাদকের চালান রোধে সীমান্তজুড়ে এবং নাফ নদ সংলগ্ন সমুদ্রপথের জলসীমায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল ও নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়।
সূত্র আরো জানায়, সম্প্রতি গহীন পাহাড়ে মানব পাচারচক্রের ঘাঁটিতে অভিযান চালিয়ে বিজিবি পাচারকারীর হাত থেকে ৮৪ জন উদ্ধার করেছে। বিজিবি ও র্যাবের সমন্বয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের উদ্ধার করা হয়। অভিযানে কয়েকটি পাহাড়ে মানব পাচারচক্রের একাধিক ঘাঁটির সন্ধান পাওয়া যায়। ওসব ঘাঁটি থেকে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে জড়ো করা ৮৪ জনকে উদ্ধার করা হয়। মানব পাচারচক্রের ঘাঁটিগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে ৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এখনো অভিযান চলমান রয়েছে। তাছাড়া কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর একটি যৌথ দলভাবে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়ার গহীন ও দুর্গম পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা করে। সেখান থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে বন্দি করে রাখা নারী ও শিশুসহ ৬৬ জনকে উদ্ধার করা হয়।
এদিকে বর্তমানে অত্যাধুনিক সরঞ্জামের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে দেশের অভ্যন্তরে কোনো কিছু প্রবেশ করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নজরদারির জন্য বসানো রাডার সর্বোচ্চ ৯৬ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত কাজ করে। এক নটিক্যাল মাইল সমান এক দশমিক ৮০০ কিলোমিটার। ৫ কিলোমিটার এলাকায় অপারেশন কার্যক্রম চালালে প্রত্যেকটি নৌকা ধরা যায়। কারণ একটি নৌকা যখন মিয়ানমার থেকে বের হয় তখনই বিজিবি তার অবস্থান সহজে জানতে পারে। শুধু রাডার নয়, বিজিবিতে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ও থার্মাল ক্যামেরা। ড্রোনের মাধ্যমে দুর্গম এলাকা যেমন সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি থার্মাল ক্যামেরায় অন্ধকার রাত কিংবা বৈরি আবহাওয়াতেও দুই কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত যে কোনো বস্তুর অবস্থান, গতি ও উপস্থিতি শনাক্ত যাচ্ছে। তাছাড়া অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোনের মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করে আটক করা সম্ভব। আর দুর্গম জালিয়া দ্বীপে ড্রোন পাঠিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি। মূলত সীমান্তে মোতায়েন করা জনবলের সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য এবং সীমান্ত ও সমুদ্রের জলসীমা দিয়ে অস্ত্র, মাদক এবং অবৈধপথে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম-উল-হক জানান, ১৮ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ১১টার দিকে কোস্ট গার্ডের একটি জাহাজ সেন্টমার্টিনের ছেড়াদ্বীপ সংলগ্ন সাগর এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে ওই এলাকায় সন্দেহজনক একটি ফিশিং বোটে তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ৩৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা মূল্যের ডাল, মশার কয়েল, রসুন, টেস্টিং সল্ট, রয়েল টাইগার এনার্জি ড্রিঙ্কস, পেঁয়াজসহ ১০ পাচারকারীকে আটক করা হয়।