বন্ধ হচ্ছে কারখানা, বিপাকে পড়ছেন কাজ হারানো শ্রমিকরা

এফএনএস এক্সক্লুসিভ | প্রকাশ: ৮ অক্টোবর, ২০২৫, ০৮:১২ এএম
বন্ধ হচ্ছে কারখানা, বিপাকে পড়ছেন কাজ হারানো শ্রমিকরা

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোতে হঠাৎ করে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন লাখো শ্রমিক। বকেয়া বেতন, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। সম্প্রতি আশুলিয়ার নাসা গ্রুপ তাদের ১২টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। এতে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন। শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, মালিকপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে কারখানা বন্ধ করে অন্য খাতে বিনিয়োগ করছে। এর আগে গাজীপুরের টঙ্গী ও কাশিমপুর এলাকায় সমপ্রতি একসঙ্গে ৩২টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। সকালে কাজে এসে শ্রমিকরা গেটে তালা ঝুলতে দেখেন। কোনো নোটিশ বা পূর্বঘোষণা ছাড়াই এভাবে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ায় হতবাক হয়ে পড়েন তারা। এতে বেকার হয়ে পড়েন অনেক শ্রমিক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শুধু অর্থনীতির জন্য নয়, কোটি মানুষের জীবিকার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকরা চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। তাদের জীবনে নেমে এসেছে হতাশা ও দুঃখ। শ্রমিকরা বলছেন, তারা শুধু তাদের ন্যায্য পাওনা চান। মালিকরা বলছেন, তারা টিকতে পারছেন না। আর সরকার বলছে, সমাধানের চেষ্টা চলছে। কিন্তু বাস্তবে শ্রমিকদের জীবন প্রতিদিন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। জানা যায়, সম্প্রতি একসঙ্গে নাসা গ্রুপের ১৬টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধের ঘোষণায় প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বেতন-ভাতা বকেয়া থাকায় তারা চরম কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে আত্মগোপনে চলে যান নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি এক্সিম ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। ২ অক্টোবর তিনি গ্রেপ্তার হন। দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের কয়েকটি মামলায় আসামি করা হয় তাকে। এর পর থেকেই অস্থিরতা তৈরি হয় নাসা গ্রুপের কারখানাগুলোতে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়তে থাকে; অপরদিকে শ্রমিকরা বিক্ষোভে নামেন। পরে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে শ্রমিক নেতাদের উপস্থিতিতে ত্রিপক্ষীয় সভায় নাসা গ্রুপের ১৬টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বলা হয়, বিদ্যুৎ-গ্যাসসংকট ও ক্রয়াদেশ না থাকায় এসব কারখানার সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় ১০টি, গাজীপুরে দুটি, চট্টগ্রাম ইপিজেডে দুটি এবং কুমিল্লা ইপিজেডে দুটি কারখানা। স্থায়ীভাবে বন্ধ নাসা গ্রুপের ১৬টি কারখানার মধ্যে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় রয়েছে এ জে সুপার গার্মেন্টস লিমিটেড, ফিরোজা গার্মেন্টস লিমিটেড, মাম গার্মেন্টস লিমিটেড, নাসা এমব্রয়ডারি লিমিটেড, নাসা সুপার গার্মেন্টস লিমিটেড, নাসা সুপার ওয়াশ লিমিটেড, নাসা সুপার ওয়াশ ইউনিট- (২), ন্যাটিভ প্যাকেজিং লিমিটেড, নাসা বেসিক লিমিটেড, নাসা হাইটেক ওয়াস লিমিটেড। গাজীপুরে অবস্থিত লিজ অ্যাপারেলস লিমিটেড, লিজ ওয়াস লিমিটেড। চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত এমএনসি অ্যাপারেলস লিমিটেড, টয় গুডস বিডি কোম্পানি লিমিটেড এবং কুমিল্লায় ইপিজেডে অবস্থিত নাসা স্পিনারস লিমিটেড ও নাসা স্পিনিং লিমিটেড। এদিকে বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়াসহ বকেয়া বেতনের দাবিতে আশুলিয়ায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ, মানববন্ধন করেন নাসা গ্রুপের শ্রমিকরা। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ করে দিয়ে কারখানা বন্ধ করা মোটেও ঠিক হয়নি। কারখানা বন্ধ করার আগে এত শ্রমিক কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে এটা ভাবা উচিত ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কলকারখানা ও পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুধু এই প্রতিষ্ঠান নয়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে পরের বছর একই সময় পর্যন্ত এক বছরে গাজীপুরের ৭২টি কলকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে নিজ নিজ কারখানা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ছয় মাসেই বন্ধ হয়েছে ২৯টি। সূত্রমতে, এভাবে, গত এক বছরে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। তাতে এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ শ্রমিক বেকার হয়েছেন। তাঁদের অনেকে চাকরির জন্য ছুটতে ছুটতে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে গ্রামে ফিরেছেন। বন্ধ কারখানার বেশির ভাগই তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার ও টেক্সটাইলশিল্পের। কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, শিল্প পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। শিল্প মালিকরা বলছেন, ব্যাংকঋণ সুদে কড়াকড়ি, শ্রমিক অসন্তোষসহ বিভিন্ন কারণে দেশে শিল্প-কারখানা বন্ধ হচ্ছেই। তাঁরা চরম সংকটের কারণেই কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার ছাড়াও কাঁচামাল আমদানিতে এলসি সমস্যা, শিল্পে অব্যাহত গ্যাসসংকট, দফায় দফায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়া, অব্যাহতভাবে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচে অনেকে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। এদিকে, কারখানা বন্ধের পর শ্রমিকরা আন্দোলনে নামছেন। গাজীপুর, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জসহ যেসব এলাকায় কারখানা রয়েছে সেসব এলাকায় প্রায়ই বিক্ষোভ হচ্ছে। শ্রমিকরা বকেয়া বেতন ও ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন। অনেক জায়গায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হচ্ছে। শ্রমিক নেতারা বলছেন, শ্রম আইন অনুযায়ী কারখানা বন্ধের আগে শ্রমিকদের নোটিশ দেওয়া এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। অন্যদিকে, সরকার বলছে, শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় তারা সচেষ্ট। শ্রম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করা হবে। তবে শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, এসব উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, শুধু স্বল্পমেয়াদি সমাধান নয়, দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। যেমন- উৎপাদন খরচ কমাতে জ্বালানি খাতে স্থিতিশীলতা আনা, শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়া, নতুন বাজার খোঁজা স্থানীয় ভ্যালু চেইন শক্তিশালী করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া।