কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় কৃষকদের মধ্যে আলোক ফাঁদ ব্যবহারের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। আর এতে অবদান রাখছে স্থানীয় কৃষি অফিস।বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কৃষকরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের প্রধান শত্রু অনিষ্টকারী পোকার উপস্থিতি নিশ্চিত করছেন। ফলে অকারণে কীটনাশক ব্যবহার কমে আসছে, কমছে কৃষি ব্যয়, রক্ষা পাচ্ছে পরিবেশ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পোকামাকড় হলো কৃষকের প্রধান দুশমন। এদের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য এতদিন কৃষকরা নির্বিচারে কীটনাশক ব্যবহার করে আসছিলেন। কিন্তু এতে যেমন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছিল, তেমনি বিষাক্ত রাসায়নিক জমির উর্বরতা নষ্ট করার পাশাপাশি পানির উৎসে মিশে মাছ ও অন্যান্য জীবের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া অকারণে বারবার বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে অনেক সময় উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হচ্ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে কৃষিতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হিসেবে 'আলোক ফাঁদ' দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এতে খরচ খুবই কম। আবার সহজেই জমিতে পোকামাকড় শনাক্ত করা যায়।
কৃষকরা জানান, এই ফাঁদ ব্যবহার করলে কীটনাশকের প্রয়োগ অর্ধেকের বেশি কমানো সম্ভব। ফলে উৎপাদন খরচ কমে যাচ্ছে এবং কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। সরেজমিন উপজেলার জগদল ব্লকের বর্শিকুরা,ডাহরা, জগদল ও বিলচাতল গ্রামের মাঠে দেখা যায়, কৃষকরা নিজেরাই আলোক ফাঁদ তৈরি করে তা জমির পাশে স্থাপন করেছেন। আর এতে সহযোগিতা করছেন স্থানীয় কৃষি অফিসের উপসহকারী কর্মকর্তারা। সাধারণত সন্ধ্যার পর আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন পোকামাকড় এসে এই ফাঁদে আটকা পড়ে। তখন সহজেই বোঝা যায় জমিতে ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ বেড়েছে কিনা।
চরপুমদী গ্রামের কৃষক আমিনুল ইসলাম বলেন,'আমরা আগে অন্ধভাবে কীটনাশক ব্যবহার করতাম। এখন রাতে আলোক ফাঁদ বসিয়ে দেখি কতটা পোকা আসে। বেশি পোকা পড়লে তখন ব্যবস্থা নেই, আর কম হলে অযথা ওষুধ দিই না। এতে আমাদের খরচ কমছে আর জমিও ভালো থাকছে।'
একই গ্রামের আরেক কৃষক শফিকুল ইসলাম জানান,'আগে প্রতি একরে অন্তত তিন-চারবার ওষুধ দিতে হতো। এখন আলোক ফাঁদ ব্যবহারের কারণে এক-দুই বার দিলেই হয়। জমির উৎপাদন খরচও কমে এসেছে। শুধু তাই নয়, আমাদের ধানক্ষেতে আগের মতো মাছ মারা যাচ্ছে না।'
জগদল ব্লকের কৃষক মো. রহিম উদ্দিন বলেন,'আলোক ফাঁদ ব্যবহারের পর আমরা বুঝতে পারি কোনটা ক্ষতিকর আর কোনটা উপকারী পোকা। আগে সব পোকাকেই মেরে ফেলতাম। এখন দেখি জমিতে অনেক উপকারী পোকা আছে, যারা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলে। এতে প্রকৃতির ভারসাম্যও রক্ষা পাচ্ছে।'
উপজেলার জগদল ব্লকের দায়িত্ব পালনরত উপ-সহকারী কৃষি অফিসার মুদাসিল হায়দার আলমগীর বলেন, 'আলোক ফাঁদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষককে সচেতন করা। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করলে মাটি ও পরিবেশ দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আমরা কৃষকদের বলছি-প্রথমে আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে পোকামাকড়ের উপস্থিতি দেখুন, তারপর প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা নিন।'
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ এ.কে.এম. শাহজাহান কবির বলেন,'পোকামাকড়ের বৈশিষ্ট্য হলো তারা সন্ধ্যার দিকে আলোর দিকে ধাবিত হয়। আলোক ফাঁদ বসালে কোন এলাকায় কোন ধরনের পোকা বেশি হচ্ছে তা সহজেই শনাক্ত করা যায়। আমরা কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি, যাতে তারা নিজেরাই পোকার উপস্থিতি দেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।'
তিনি আরও বলেন,'আলোক ফাঁদ ব্যবহারে কৃষকরা শুধু লাভবান হচ্ছেন না, পাশাপাশি পরিবেশও সুরক্ষিত থাকছে। আমরা চাই হোসেনপুর উপজেলায় প্রতিটি ব্লকেই কৃষকরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করুক।'