তামাবিল সীমান্তে আজ সকালের সূর্য কিছুটা অন্যরকম আলো ছড়িয়েছে। যেন সেই আলো খুঁজছিল সেই মানুষটিকে, যিনি ঠিক এই পথ দিয়েই এক রাতে অদৃশ্য হয়েছিলেন । সালাহউদ্দিন আহমেদ। নয় বছর পর, নিজের জীবনের সবচেয়ে রহস্যঘেরা অধ্যায়ের সেই ‘শেষ প্রান্তে’ এসে দাঁড়ালেন তিনি। ফিরে এলেন, মুখোমুখি হতে অতীতের সেই নিঃসঙ্গ অন্ধকারের।
২০১৫ সালের ১০ মে, রাতের নীরবতা চিরে এই সীমান্ত দিয়েই তাকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এমনটাই তার দাবি। আজ, সেই সীমান্তে দাঁড়িয়ে সালাহউদ্দিন যেন ফিরে পেলেন কিছুটা ভাষাহীন বিচার। তবে কেবল আইনের নয়, ইতিহাসেরও।
এই সফরটি শুধুই ব্যক্তিগত কোনো আবেগ নয় । এটি ছিল একটি ডকুমেন্টারির অংশ, যেখানে সালাহউদ্দিন সরাসরি গুম ও নির্যাতনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। বাংলাদেশের গুম-খুনের ইতিহাসে তিনি এখন কেবল একজন রাজনীতিক নন, এক জীবন্ত দলিল।
গুমের গল্প, রাজনীতির গলিপথে সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আজ আর শুধুই একটি ব্যক্তি নিখোঁজের কাহিনি নয়। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে অস্বস্তিকর অধ্যায়গুলোর একটি।
২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাতে ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন। সরকার জানায় কিছুই জানে না, পরিবার বলে ‘তুলে নেওয়া হয়েছে’। ৬৩ দিন পর খোঁজ মিলল ভারতের শিলং-এ, এক হাসপাতালের মানসিক ওয়ার্ডে। রাষ্ট্র তাকে ‘উদভ্রান্ত অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করল, পরিবার বলল। ‘সরকারি অপারেশন’।
নয় বছর কেটেছে ভারতের মেঘালয়ে। দুই দেশের কূটনৈতিক জট, আদালতের দীর্ঘসূত্রতা, পাসপোর্ট না থাকা। সব কিছু পার করে অবশেষে ২০২৩ সালের আগস্টে ফিরলেন দেশে। বদলে গেছে সরকার, বদলায়নি সালাহউদ্দিনের অবস্থান
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরের দিনই তিনি পেলেন ট্রাভেল পাস। ১১ আগস্ট, এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে ফিরলেন কক্সবাজারে। যেন রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে সাথে খুলে গেল আটকে থাকা দরজাগুলো।
তবে দেশে ফিরে তিনি শুধু নীরব প্রত্যাবর্তনেই থেমে থাকেননি। ৩ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে সরাসরি গিয়ে গুমের অভিযোগ জমা দেন। শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, দুই সাবেক আইজিপি, র্যাবের সাবেক ডিজি সহ মোট সাতজনের নাম উল্লেখ করেন।
অভিযোগটি দেশের ইতিহাসে বিরল। কারণ এটি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সরাসরি গুমের অভিযোগ দায়ের, যেখানে আসামিদের তালিকায় আছেন একটি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। গুম থেকে গম্ভীর প্রত্যাবর্তন: রাজনীতির নতুন মোড়?
সালাহউদ্দিনের এই প্রত্যাবর্তন ও আইনি লড়াই কি বিএনপির জন্য একটি নতুন কৌশল? নাকি এটি গুমের রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ?
এই প্রশ্নের উত্তর সময় দেবে, তবে এটুকু স্পষ্ট। নয় বছরের রাজনৈতিক নির্বাসন শেষে সালাহউদ্দিন কেবল ফিরলেন না, তিনি প্রশ্ন তুললেন। একটি দেশের রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের অস্তিত্বকে ঘিরে এক ‘অপ্রিয় সত্য’ তুলে ধরলেন।
তামাবিলের বাতাসে আজ ইতিহাসের গন্ধ সকালে সীমান্তে দাঁড়িয়ে, বিকেলে হযরত শাহপরাণ (র.) মাজারে জিয়ারত করে ঢাকায় ফেরার আগ পর্যন্ত তার চারপাশে ঘুরছিল সংবাদকর্মী, কৌতূহলী চোখ আর ক্যামেরার ঝলকানি। কিন্তু এর চেয়েও বেশি। তিনি ঘিরে রেখেছিলেন ইতিহাসের এক নীরব চাপ।
সালাহউদ্দিন আহমেদ আর শুধু বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নন। তিনি এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। যিনি গুম হয়েছেন, আবার ফিরেছেন। যিনি হারাননি, হারিয়ে গিয়েও।