রাজশাহী মহানগরী গত এক দশক ধরে পরিচ্ছন্নতা ও সবুজায়নের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করলেও, সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং স্থানীয় পর্যবেক্ষণগুলি ইঙ্গিত করে যে শহরটি এক গুরুতর প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যৌথ প্রভাবে এই সংকট তীব্র হয়েছে।
উদ্বেগের মূল বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে - ভূমি পৃষ্ঠের তাপমাত্রা (খঝঞ) বৃদ্ধি পাওয়ায় আরবান হিট আইল্যান্ড (টঐও) প্রভাব তীব্রতর হওয়া; প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে প্রাকৃতিক জলাশয়, বিশেষত পুকুরগুলির, ব্যাপক হারে ভরাট হওয়া (যা মোট জলাশয়ের প্রায় ৯৭ শতাংশ); এবং অপরিহার্য অবকাঠামো উন্নয়নের অজুহাতে ঐতিহ্যবাহী ও শতবর্ষী বৃক্ষ নিধন। এই সংকট কেবল বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যকেই নষ্ট করছে না, বরং বরেন্দ্র অঞ্চলে মরুকরণের ঝুঁকি বাড়িয়ে এবং জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে।
রাজশাহী মহানগরী ঐতিহাসিকভাবে ‘শিক্ষানগরী’, ‘রেশম নগরী’ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সুপরিচিত। শহরটি পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের জন্য বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন লাভ করেছে। ২০১২ ও ২০২১ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) ‘জাতীয় পরিবেশ পদক’ লাভ করে। এছাড়া, ২০১৬ সালে বাতাসে ক্ষতিকর ধূলিকণা (চগ ২.৫) কমাতে বিশ্বের সেরা শহর হিসেবে এবং ২০২০ সালে ‘এনভায়রনমেন্ট ফ্রেন্ডলি সিটি অফ দ্য ইয়ার’ সম্মাননা অর্জন করে। সবুজায়ন ও সড়ক সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যমে রাজশাহী আধুনিক ও আলো ঝলমলে এক দৃষ্টিনন্দন শহরে পরিণত হয়েছে।
তবে, পরিবেশবিদ ও সচেতন নাগরিক সমাজ এই অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁরা মনে করেন যে, সামগ্রিক পরিবেশের দিক দিয়ে মহানগরবাসী কতটুকু নিরাপদে আছেন, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। তাদের মতে, নগরী ও সংলগ্ন বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশ বর্তমানে মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে।
গত ০৪ অক্টোবর ২০২৫ইং দৈনিক ‘আমাদের সময়’ পত্রিকার শেষের পাতায় “রাজশাহীতে ৩ দশকে সবুজ এলাকা কমেছে ২৬ শতাংশ” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে, ‘রাজশাহী নগরীর শীতকালীন ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা গত তিন দশকে ধারাবাহিক ভাবে উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। একই সময়ে নগরীর সবুজ এলাকা কমছে ২৬ শতাংশ এবং জলধার কমেছে ৩ শতাংশ। এর বিপরীতে বেড়েছে নগরায়ন।’
‘সাস্টেইনেবিলিটি’ নামক পিয়ার-রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত ‘রিমোট সেন্সিং ও জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের যৌথভাবে করা গবেষণার উদ্বৃতি দিয়ে সেই প্রতিবেদেনে বলা হয় যে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শহরে তাপমাত্রা বেড়েছে। যা নগরীতে দীর্ঘমেয়াদী বাসযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে।
সম্প্রতি কালেরকণ্ঠ পত্রিকায় ‘বনায়ন-জলধার কমায় বাড়ছে তাপমাত্রা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ‘১৯৯০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহী শহরে শীতকালে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ২.৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, যেখানে কিছু এলাকায় এই বৃদ্ধির হার ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। জাতিসংঘের একটি সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের গাইডলাইন অনুযায়ী, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার প্রতি দশকে ০.২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়া উচিত নয়। সেই তুলনায় রাজশাহী নগরীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো শহরে সবুজায়ন ও জলাশয় কমে যাওয়া, যা কংক্রিট ও অন্যান্য অপরিবাহী পৃষ্ঠ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।’ গত তিন দশকে সবুজ এলাকা কমেছে ১২.৪৮ বর্গকিলোমিটার এবং জলাশয় কমেছে ১.৪৪ বর্গকিলোমিটার বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
‘রাজশাহীতে গাছ কাটার মচ্ছব’ শিরোনামে সম্প্রতি ‘আজকের পত্রিকা’তে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজশাহীতে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কাটা পড়ছে ২ হাজার ৩২৩টি গাছ। ইতিমধ্যে এক প্রকল্পের ৪১৮টি গাছ কাটা শুরু হয়েছে। একে গাছ কাটার ‘মহোৎসব’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেখানে আরো বলা হয় ওয়াসা জমি অধিগ্রহণ করলে ২২২টি গাছ রক্ষা করা সম্ভব আর ১ হাজার ৮৫৩টি গাছ কেটে নতুন গাছ লাগাতে চায় রামেবি।
প্রকাশিত প্রতিবেদনটির তথ্য বলছে যে, নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৮৫৩টি গাছ কাটতে চায় রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (রামেবি) কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া রাজশাহী পানি সরবরাহ ও পয়:নিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) নতুন পাইপলাইন স্থাপনের জন্য ৪১৮টি গাছ কাটছে সড়ক বিভাগ। আর ৫২টি গাছ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে রাজশাহী সার্কিট হাউস সম্প্রসারণে।
‘কাটা হচ্ছে তিন শতাধিক গাছ’ শিরোনামে গত ২৯ সেপ্টেম্বর একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা। সেই প্রতিবেদনে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামের শিক্ষক ও কবি এস এম তিতুমীরের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সব উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ থাকে, কিন্তু প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয় না। উন্নয়নের প্রথম শর্তই যেন গাছ কাঁটা।’
‘রাজশাহীতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আবারও পুকুর ভরাট’ শিরোনামে ১৪ সেপ্টেম্বর ‘আমাদের সময় ডটকম’ ও ‘রাজশাহীতে আবারও পুকুর ভরাটের অভিযোগ’ শিরোনামে ৩ অক্টোবর ২০২৫ইং ‘দি ঢাকা এঙ্প্রেস ডটকম’ ও ‘সকালের বুলেটিন’ অনলাইনে পৃথক সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
‘আমাদের সময় ডটকম’ এ প্রকাশিত প্রতিবেদন এ বলা হয় যে, ‘উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও রাজশাহীর ঘোষপাড়া (ফকিরপাড়া) এলাকার প্রায় সাড়ে তিন বিঘা আয়তনের ঐতিহ্যবাহী ‘জোড়া পুকুর’ ভরাট হওয়ার পর পুনরুদ্ধার করা হলেও সেটা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আবারও ভরাট করা হচ্ছে।
‘দি ঢাকা এঙ্প্রেস ডটকম’ ও ‘সকালের বুলেটিন’ প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে যে, রাজশাহী নগরীর খুলিপাড়া এলাকায় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আবারও হচ্ছে পুকুর ভরাট। বিএনপির হাইব্রিড নেতা এস এম এখলাস আহ্মদ রমি প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ধাপে ধাপে পুকুর ভরাট করছে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে, প্রথমবারের মতো ভরাটের চেষ্টা চললেও এলাকাবাসী সরাসরি বাধা দেয়। বাধা অগ্রাহ্য করে রমি ভরাট চালিয়ে যেতে থাকলে স্থানীয় উন্নয়নমূলক যুব সংগঠন ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ (ইয়্যাস) মানববন্ধনের আয়োজন করে। ৭ই মার্চ বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠিত মানববন্ধনের পর প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এসে ভরাট বন্ধের নির্দেশ দেন।
এদিকে রাজশাহীর 'শুকান দিঘি' নগরীর সপুরা এলাকায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ও সংরক্ষিত জলাশয়, যার আয়তন প্রায় তিন একরের বেশি। নাম 'শুকান' হলেও এটি সারা বছর জলে পূর্ণ থাকে এবং নগরীর পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রভাবশালী মহলের পক্ষ থেকে রাতের আঁধারে এটি বারবার ভরাট করার চেষ্টা হয়েছে, যা এর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে এবং স্থানীয় পরিবেশকর্মীদের উদ্বেগের প্রধান কারণ। এ বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।
অন্যদিকে, সম্প্রতি ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ‘পরিচ্ছন্ন নগরীর সুনাম হারাচ্ছে রাজশাহী’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে যা জানা গেছে তা হলো- এক বছর ধরে জনপ্রতিনিধি (মেয়র ও কাউন্সিলর) না থাকায় রাজশাহী মহানগরী তার ‘সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন নগরীর’ সুনাম হারাচ্ছে। শহরজুড়ে ফুটপাত ও রাস্তা অবৈধভাবে দখল, আবর্জনার স্তূপ ও দূষণ এবং অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশার কারণে তৈরি হওয়া তীব্র যানজটে নগরবাসী প্রতিনিয়ত নাকাল হচ্ছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও সেবার অভাবই এই পরিস্থিতির জন্য মূলত দায়ী।
সাম্প্রতিকালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব প্রতিবেদনই বলে দেয় যে- রাজশাহীর বর্তমান পরিস্থিতি কি ভয়াবহ। এই পরিস্থিতি পরিবেশগত অর্জনগুলোকে ম্লান করে দিয়ে শহরটিকে ধীরে ধীরে ‘সবুজ নগরী’ থেকে 'উষ্ণায়ন কেন্দ্রে' পরিণত করছে। তাই রাজশাহীর অর্জনগুলোকে ম্লান হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে অবিলম্বে সংস্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়গুলো কেন্দ্র করে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর পাশাপাশি আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে পরিবেশ-প্রতিবেশ, প্রাণপ্রকৃতি-প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায়।
মো. শামীউল আলীম শাওন লেখক এবং উন্নয়ন ও অধিকারকর্মী শ্রেষ্ঠ যুব সম্মাননাপ্রাপ্ত