বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে শিক্ষকদের শতাংশ হারে বাড়ি বৃদ্ধি নিয়ে কাজ শুরু করেছে অর্থ বিভাগ। তবে কবে নাগাদ নতুন পরিপত্র জারি হবে সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠি চালাচালিতে সময় ক্ষেপণ করার অপচেষ্টায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি প্রত্যাখান করে গতকাল রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষক আন্দোলন ও অবস্থান কর্মসূচি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্ম বিরতির বিষয়টি ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লক্ষাধিক শিক্ষক কর্মচারীর উপস্থিতি ঘটানো হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি পালন করা হবে।
নতুনভাবে দ্বিতীয়বার দেশ স্বাধীন হয়েছে, হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন, বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার কাজ চলছে, বৈষম্য দূর হচ্ছে, বেসরকারি শিক্ষক, কর্মচারী এবং সরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের সাথে বাড়িভাড়া, মেডিক্যাল ভাতা বেতনের আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। সুযোগ সুবিধারও অনেক বৈষম্য রয়েছে।
বিগত দিনে জাতীয় প্রেসক্লাবে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক, কর্মচারীগণ জাতীয়করণের জন্য দিনের পর দিন আন্দোলন করছেন, স্কুলে স্কুলে তালা ঝুলিয়েছেন, বেশিরভাগ শিক্ষক আন্দোলনে ঢাকায় অবস্থান করছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি দুর্নীতিবাজ লুটপাটকারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার দোসর আমলা ও শিক্ষামন্ত্রীদের কারণে।
শিক্ষক-কর্মচারীদের শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে অর্থ বিভাগের এক উপসচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির পুনর্বিবেচনার চিঠি আমরা পেয়েছি। কত শতাংশ বৃদ্ধি করা যাবে, সেটি আগে যাচাই করে দেখতে হবে। কেননা এখানে অর্থের জোগান কীভাবে হবে সেটিও দেখতে হবে।
কবে নাগাদ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির নতুন পরিপত্র জারি হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এটি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমরা জুনিয়র লেভেলের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারি না। অর্থ সচিব এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার অনুমোদন সাপেক্ষে পরিপত্র জারি করা হবে। এটি জারি করতে কিছুটা সময় লাগবে।’
এদিকে ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া এবং ১৫০০ টাকা মেডিক্যাল ভাতার দাবি আদায়ে গতকাল রোববার থেকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজীজি বলেন, ‘প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। সরকার দাবি মেনে নিতে গড়িমসি করলে লাগাতার অবস্থানের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেওয়া হবে।’
জানা গেছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের গত ১৩ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের শিক্ষক সমাবেশে লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী উপস্থিত ছিল। ওইদিন শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেসিকের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া, ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
কিন্তু দীর্ঘ দুই মাস অতিবাহিত হলেও প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ। এমতাবস্থায় এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেসিকের ২০% বাড়ি ভাড়া, ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ও শতভাগ উৎসব ভাতার প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শান্তিপূর্ণ লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।
এর আগে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া ৫০০ টাকা বৃদ্ধি করে পরিপত্র জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরারের এক চিঠির প্রেক্ষিতে বাড়ি ভাড়া ৫০০ টাকা বাড়িয়ে দেড় হাজার টাকা করা হয়। তবে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানান শিক্ষক-কর্মচারীরা। গত ৩০ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রবিধি শাখা থেকে শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ৫০০ টাকা বৃদ্ধিসংক্রান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। ভাড়া বৃদ্ধির পরিপত্র গত ৫ অক্টোবর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রবিধি শাখার উপসচিব মোসা. শরীফুন্নেসা এতে স্বাক্ষর করেছেন। পরিপত্রে বলা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া ভাতা নিম্নোক্ত শর্তাদি পালন সাপেক্ষে ১ হাজার হাজার টাকা হতে বৃদ্ধি করে ১ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হলো। শর্তে বলা হয়েছে, ‘এ ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে যাবতীয় আর্থিক বিধি-বিধান যথাযথভাবে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে; এ ভাতা সংক্রান্ত ব্যয়ে ভবিষ্যতে কোনো অনিয়ম দেখা দিলে বিল পরিশোধকারী কর্তৃপক্ষ উক্ত অনিয়মের জন্য দায়ী থাকবেন। প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক আদেশ জারির তারিখ হতে ভাতা কার্যকর হবে। প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক জিও জারি করে জিও এর ০৪(চার) কপি অর্থ বিভাগে পৃষ্ঠাংকনের নিমিত্ত প্রেরণ করতে হবে।’
মানসম্মত শিক্ষা ও মেধাবী জাতি গঠনে জাতীয়করণের বিকল্প নেই। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে আমাদের অবস্থান তলানিতে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হাস্যরসের খোরাক হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিক্ষাখাতকে প্রাধান্য দেওয়া, মাধ্যমিক শিক্ষাকে গতিশীল করা, মাধ্যমিক পর্যায়ে মেধাবিকাশে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালুকরণ জাতীয়করণ ছাড়া সম্ভব নয়। বর্তমানে শিক্ষকতার পেশাটাকে মুখে মুখে সম্মানজনক পেশা বলা হলেও গ্রেড অনুপাতে বেতন, কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের আচরণ, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা আর সিকি উৎসবভাতা কিন্তু অন্যটা প্রমাণ করে। আমরা যে শতভাগ অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার তা কিন্তু এই বেতন ও সামান্য সুবিধা প্রমাণ করে। অন্যান্য চাকরি বঞ্চিত হলে একান্ত বাধ্য হয়ে তারা এ পেশায় এলেও বেতন, ভাতা ও মূর্খ পরিচালনা কমিটি দেখে পড়ানোর মানসিকতা পরিবর্তন করে তারা এটাকে চাকরি হিসেবে বেছে নেয় সেবা হিসেবে নয়। এটা জাতির জন্য অশনিসংকেত।
অভাবগ্রস্ত শিক্ষকরা মানসিক ভাবেও বিপদ্গ্রস্ত। অভাব যখন চারদিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে তখন নিদারুণ কষ্টের ভাণ্ডার থেকে সৃজনশীল কিছু পাওয়ার চিন্তাই বৃথা। তাই অতিশীঘ্র জাতীয়করণ না হলে এ শিক্ষা ব্যবস্থায় অরাজকতা বৃদ্ধি পাবে, শিক্ষায় প্রতিযোগিতা আরও কমবে এবং এসব সেক্টরে প্রচণ্ড অসন্তুষ্টি দেখা দেবে। আমাদের দেশের চেয়েও অনুন্নত বেশ কয়েকটি এশিয়ান রাষ্ট্রে শিক্ষা খাতে সর্বনিম্ন জিডিপি ৩.৫০ বা ৪ শতাংশ সেখানে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হয়েও আমাদের জিডিপি ২.০৯ শতাংশ। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। দেশের মাধ্যমিক, উচ্চ শিক্ষাসহ সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাণবন্ত করতে, আশানুরূপ ফলাফল পেতে জাতীয়করণ একান্ত প্রয়োজন। বিশাল বাজেটের আংশিক এবং প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের আয় জমা নিয়ে জাতীয়করণ করলে শিক্ষক/শিক্ষার্থী/ অভিভাবকগণ যেমন উপকৃত হবে তেমনি আমাদের শিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান ও কৌশল অবলম্বন করে বাস্তবিক প্রয়োগ সম্ভব হবে। বেসরকারি শিক্ষকদের হাহাকার নিরসনে এখনই জাতীয়করণের মোক্ষম সুযোগ।
বেসরকারি শিক্ষকদের কষ্টের কথা বিবেচনা করে প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে বেসরকারি শিক্ষক সমাজের প্রাণের দাবি একটা সেটা হলো, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের পাহাড়সম বৈষম্য দূর করতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একযোগে জাতীয়করণ করার। এ ঘোষণার অপেক্ষায় শিক্ষক সমাজ তীর্থের কাকের ন্যায় চেয়ে আছেন। কঠিন কাজটি করার জন্য বেসরকারি শিক্ষক পরিবারের লাখ লাখ সদস্য আপনাদের জন্য জায়নামাজে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করবেন। দেশে বিদেশে বেসরকারি শিক্ষকদের জীবনধারার উন্নয়নের জন্য প্রশংসিত হবেন। এর জন্য যেটা বিনিয়োগ করবেন সেটা হবে শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। কোটি কোটি শিক্ষার্থীদের আর ক্ষতি হবে না। বেসরকারি শিক্ষকসমাজ শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাবেন। আর যদি সম্ভাব না হয় তবে ২০ ভাগ বাড়িভাড়া, ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, ৭৫ ভাগ উৎসব ভাতার পরিপত্র জারি করে কোটি কোটি শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষকদের প্রাণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণি কক্ষে ফিরে যাওয়া ও পাঠদান স্বাভাবিক রাখতে সরকারের হস্তক্ষেপে কামনা করছি।
লেখক: মো : হায়দার আলী; সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্ট