পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গল সুন্দরবন। প্রকৃতির এই ভয়াল অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনের কোলে বসবাসরত স্থানীয় ও বনজীবীদের মনে শান্তি নেই। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচতে তাদের অভিনব কৌশল অবলম্বন করতেন।
১৯৮০-এর দশকে সুন্দরবনে বনজীবীরা নিজেদের বাঘের হাত থেকে রক্ষা করতে মাথার পেছনে এক ধরনের মুখোশ পরে বনের গভীরে প্রবেশ করতেন, যা বাঘকে বিভ্রান্ত করতে সাহায্য করত। বাঘ শিকারি প্রাণী হলেও, মুখ পেছনে থাকা অবস্থায় তারা মানুষের ওপর আক্রমণ করত না, কারণ তারা মনে করত মানুষটি তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। এভাবে, মুখোশ পরে বনজীবী জীবনযাত্রা ছিল সুন্দরবন অঞ্চলের এক ব্যতিক্রমী ও যুগান্তকারী কৌশল, যা মানুষের টিকে থাকার এক নিদর্শন।
সুন্দরবনের বনজীবীরা মাছ ধরা, মধু সংগ্রহ ও কাঠ কাটার মতো কাজের জন্য বনের গভীরে যেতে হয়। বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচতে তারা এই অভিনব কৌশল অবলম্বন করতেন। মুখোশটি পরার পর বনজীবীরা বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতেন। মুখোশের পেছনে চোখ থাকায় বাঘ মনে করত, বনজীবীটি তাদের দিকেই তাকাচ্ছে, যা তাদের আক্রমণ করতে দ্বিধা সৃষ্টি করত। তবে সময়ের সাথে সাথে বাঘ এই কৌশল বুঝতে পারে, ফলে মুখোশ পরে বনের গভীরে যাওয়া আর নিরাপদ থাকে না। বাঘ ছাড়াও সুন্দরবনে কুমির, সাপ ও অন্যান্য বিপজ্জনক প্রাণী রয়েছে, যারা এই মুখোশ কৌশল দ্বারা সুরক্ষিত নয়।
সুন্দরবনের মৌয়ালরা মুখোশ বা পেছনমুখী মুখোশ পরে থাকেন বাঘের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য। এটার পেছনে বেশ যুক্তিসংগত কারণ আছে। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার সাধারণত পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে। বাঘের শিকার কৌশল হলো, নিঃশব্দে অনুসরণ করে পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া। গবেষণা অনুযায়ী, যদি কেউ বাঘটিকে চোখে চোখে রাখে, তখন বাঘ আক্রমণে দ্বিধা করে।
সুন্দরবনে বসবাসরত রয়েল বেঙ্গল টাইগার সাধারণত শিকারে ধূর্ত ও সাবধানি। তারা অধিকাংশ সময়েই পেছন দিক থেকে চুপিসারে হামলা করে। এই আচরণগত বৈশিষ্ট্য বুঝতে পেরে স্থানীয়রা একটি কৌশল উদ্ভাবন করেন, পেছনে একটি মুখোশ পরা, যাতে দুটি বড়বড় চোখ আঁকা থাকে। এই মুখোশ দেখে বাঘটি বিভ্রান্ত হত, কারণ তাকে মনে হত তার শিকার যেন তার উপস্থিতি বুঝতে পেরেছে এবং তাকে নজরে রাখছে।
স্থানীয় লোকজন ও সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বাঘের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। স্থানীয় জেলেরা বনদেবী বনবিবির প্রার্থনা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে যাত্রা শুরুর আগে। সুন্দরবনে নিরাপদ বিচরণের জন্য প্রার্থনা করাও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে জরুরি। বাঘ যেহেতু সবসময় পেছন থেকে আক্রমণ করে সেহেতু জেলে এবং কাঠুরেরা মাথার পেছনে মুখোশ পরে। এ ব্যবস্থা স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করলেও পরে বাঘ এ কৌশল বুঝে ফেলে এবং আবারও আক্রমণ হতে থাকে। সরকারি কর্মকর্তারা আমেরিকান ফুটবল খেলোয়াড়দের প্যাডের মত শক্ত প্যাড পরেন যা গলার পেছনের অংশ ঢেকে রাখে। এ ব্যবস্থা করা হয় শিরদাঁড়ায় বাঘের কামড় প্রতিরোধ করার জন্য যা তাদের পছন্দের আক্রমণ কৌশল।
ফলে বাঘটি হামলার আগেই পিছিয়ে যেত এবং অপেক্ষা করত আরও অসচেতন, দুর্বল বা একাকী কোনো শিকারির। এভাবেই অনেক মানুষের জীবন রক্ষা পেত, যারা দিনের পর দিন জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বনের গহিনে প্রবেশ করতেন।
এই মুখোশ পদ্ধতি প্রথমে একটি ছোট পরিসরে শুরু হলেও পরে তা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি বনবিভাগ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকারী সংস্থারাও এই পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করেন এবং তা কোনো একপর্যায়ে উৎসাহিতও করা হয়। এই পদ্ধতি পুরোপুরি নিরাপদ নয়, তবে বনবিভাগের তথ্য অনুযায়ী এটি বাঘের আক্রমণ প্রায় ৩০/৪০ শতাংশ কমিয়েছে। বর্তমানে বনবিভাগ ও স্থানীয় এনজিওগুলো মৌয়ালদের প্রশিক্ষণ ও প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম মুখোশ, জাল, হেলমেট দিয়ে থাকে।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলে গেছে। বন এখন আগের মতো বিস্তৃত ও প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর নয় এবং বাঘের সংখ্যাও আগের চেয়ে কমে এসেছে। একই সঙ্গে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় মানুষের কাছে এসেছে রেডিও কলার, মনিটরিং ক্যামেরা ও আরও উন্নত সুরক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু তারপরও, সেই দশকের পেছনের চোখের মুখোশ রয়ে গেছে এক স্মারক হিসেবে। একটি অদ্ভুত ও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল, যা মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষার সাক্ষ্য বহন করে।
সুন্দরবনের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু মাথার পেছনে একটি মুখোশ পরে, কেবল দুটি আঁকা চোখের জোরে যে কৌশলে বাঘের মতো ভয়ংকর শিকারিকে ঠেকিয়ে দেওয়া যেত, তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। এটি শুধু কৌশল নয়, বরং মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের এক অনন্য উদাহরণ।
১৯৭২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘকে উপদ্রব বলে গণ্য করা হত। তখন অনুমোদনপ্রাপ্ত যে কোনো শিকারি বাঘ মেরে চামড়া ও মাথার খুলি বন অফিসে জমা দিলে তাঁকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হত। ১৯৭৩ সালে জারীকৃত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বনে এখন সকল প্রকার প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ, বন দফতর থেকে মানুষখেকো বলে কাগজে পত্রে ঘোষণা করলে তবেই কেবল সেই বাঘ মারা যায়।
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। আমাজান অবশ্য ভয়ংকর কিন্তু সেখানে সুন্দরবনের মতো ভয়ংকর বাঘ নেই। সাধারণ ভাবে বাঘ এবং অন্যান্য বিগ ক্যাট সীমানা চিহ্নিত করতে প্রস্রাব করে গন্ধ ছড়িয়ে রাখে। কেউ সীমানা অতিক্রম করলে অ্যাগ্রেসিভ ভাবে চলাচল করে বাধ্য হয়ে। জোয়ারের কারণে সুন্দরবনের বাঘ এভাবে চিহ্ন দিলেও তা থাকেনা। তবে ২ বার জোয়ারের পানিতে ধুয়ে যায়, তাই ওরা সহজাতভাবে হিংস্র হয়ে ওঠে। এছাড়া উপকূলীয় এ অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে সাইক্লোন প্রবল এলাকা। প্রচুর মৃত প্রাণী ও মানবদেহ জোয়ারের টানে ভেসে আসে জঙ্গলের ভেতরে আর তা বাঘের খাদ্যও হয়ে যায়। এভাবেই বাঘ নরখাদক হচ্ছে। সুন্দরবনের অনেক প্রাণীই বন মোষ, একশৃঙ্গ গন্ডার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফুড সার্কেলেও এর প্রভাব রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আচরণকে উলটাপালটা করে দিয়েছে। সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক শিকারভূমি।
বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবন অঞ্চলে জাতিধর্ম নির্বিশেষে পূজিত দক্ষিণরায় এক লোকদেবতা। তাঁকে পশু ও দানবদের নিয়ন্ত্রক বা বাঘের রাজা মনে করা হয়। সুন্দরবনের অধিবাসীরা দক্ষিণরায়কে সুন্দরবনের ভাটি অঞ্চলের অধিপতি মনে করেন। সুন্দরবনের অধিবাসীরা ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে মাছধরা, কাঠ বা মধু আহরণের মতো কোনো কাজে যাওয়ার আগে দক্ষিণরায়ের মন্দিরে পূজা দেন। কেউ কেউ মাথার পিছন দিকে দক্ষিণরায়ের মুখোশ পরে জঙ্গলে ঢোকেন যাতে বাঘ সেই মুখোশ দেখে ভয় পেয়ে তার কাছে না আসে।
বনবিবি হলেন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত সুন্দরবন অঞ্চলে মৎস্যজীবী, মধু-সংগ্রহকারী ও কাঠুরিয়া জনগোষ্ঠীর দ্বারা পূজিত এক লৌকিক দেবী বনবিবি তথা পিরানি। উক্ত জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বনবিবির পূজা করে। বনবিবি বনদেবী, বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী বা বণচণ্ডী নামেও পরিচিত। বনবিবি হিন্দুসমাজে বনদুর্গা, বনচণ্ডী বা বনদেবী নামেও পূজিতা হন। কোনও কোনও মন্দিরে তিন ব্যাঘ্র-দেবদেবী বনবিবি, দক্ষিণরায় ও কালুরায় একসঙ্গে পূজিত হন। আবার কোথাও বনবিবি-শাজঙ্গুলির যুগ্ম বিগ্রহও পূজিত হতে দেখা যায়।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ বছরে ২০০১-২০২৫ পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে ৪২৫ জন মারা গেছেন। এই সময়ে আহত হয়েছেন ৯৫ জন। তবে এর বাইরেও আহত-নিহতদের একটা বড়ো সংখ্যা রয়েছে যারা বন বিভাগের তালিকায় আসেনি। ২০১১ সালে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নীতিমালা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে আহত ও নিহতদের। বন্যপ্রাণী আইনের মানুষের জানমালের ক্ষতিপূরণ নীতিমালা অনুযায়ী, বন্যপ্রাণীর আক্রমণে কেউ মারা গেলে ১ লাখ, আহত হলে ৫০ হাজার এবং বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হলে ২৫ হাজার টাকা পায়।
বনসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বাঘের আক্রমণে শিকার হয়। আহত ও নিহতদের পরিবারগুলো খুবই অসহায় হয়ে পড়ে। নানা নিয়মকানুনের বেড়াজালে তারা সরকারি সহযোগিতাও পায় না। আর সরকার যে সহযোগিতা করে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। আহত-নিহতের পরিবারগুলোর আর স্বাভাবিক জীবনের ফিরে আসতে পারে না। ভয়ংকর স্মৃতি নিয়ে তাদের বেঁচে থাকতে হয়।
ভয়ংকর সুন্দর সুন্দরবন। বনে মাঝে মাঝে বাঘের ভীম গর্জন, ফণা তোলা বিষধর সাপ ও কুমিরের বিচরণ গায়ে কাঁটা দেয়ার মতো। সৌন্দর্য আর রোমাঞ্চের এমন মিশেল সুন্দরবন ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া দুষ্কর। রাত বাড়লে বাতাসের গতি বদলে যায়। গাছের পাতাগুলো যেন কাউকে সাবধান করতে কাঁপছে। মাঝেমধ্যে অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়। যেন কেউ হাসছে, কেউ আবার দূর থেকে ডাকছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, সেই আওয়াজের দিকে গেলে কিছুই পাওয়া যায় না। গায়ে কাঁটা দেয়ার আরেক নাম ভয়ংকর সুন্দর সুন্দরবন।
১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তৃত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবনে, এক ব্যতিক্রমধর্মী দৃশ্য প্রায় নিয়মিতই দেখা যেত। সুন্দরবনে মাথার পেছনে একটা মুখোশ লাগিয়ে এরপর বনের ভেতর যেতেন মৌয়ালরা। এই কৌশলের মাধ্যমে তারা বাঘের আক্রমণ থেকে অনেকটাই রক্ষা পেতেন। মৌয়ালরা মাথার পেছনে একটি মুখোশ উলটো করে পরে। এতে বাঘ মনে করে, মানুষ সবসময় তাকে সামনে থেকে দেখছে। ফলে বাঘ সাধারণত আক্রমণ না করে দূরে থাকে।
জীবিকার প্রয়োজনে যারা বনের গভীরে মাছ ধরা, মধু সংগ্রহ কিংবা কাঠ কাটাসহ ইত্যাদি কাজ করতে যেতেন, তাদের অনেকেই মাথার পেছনে এক ধরনের মুখোশ পরে বনে ঢ়ুকতেন। এটি ছিল বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচার এক অভিনব এবং কার্যকর কৌশল।
লেখক: প্রকাশ ঘোষ বিধান; সাংবাদিক ও কলামিস্ট