কুমিল্লার হোমনা উপজেলা সদরের ব্যস্ত বাসস্ট্যান্ড এলাকা কিংবা পৌর স্টেডিয়ামের পাশে পতিত জমিতে এখন চোখে পড়ে উজ্জ্বল হলুদ ফুলের সারি। দূর থেকে মনে হয় যেন মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে কেউ। সোনালী আলোয় প্রজ্জ্বলিত একটি বন। স্থানীয়রা একে চেনে দাদমর্দন ফুল নামে। অযত্নে, অনাদরে আর প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে গজিয়ে ওঠা এই ফুল এখন হোমনার বাসস্ট্যান্ড ও পৌর এলাকার শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ ফুল কেউ রোপণ করে না, দেয় না সার বা কীটনাশক। প্রতি বছর বর্ষা পেরিয়ে শরতের সূর্যালোক যখন প্রকৃতিকে নতুন রঙে রাঙায়, তখনই হোমনার নির্জন ও পতিত জায়গাগুলোতে মাথা তুলে দাঁড়ায় দাদমর্দন গাছ। মৌসুম শেষে আবার ঝরে পড়ে, মাটিতে মিশে যায়, কিন্তু পরের বছর সেই মাটিতেই নতুন চারা গজায় একেবারে নিজের মতো করে।
দাদমর্দন ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম ঝবহহধ ধষধঃধ (সেন্না আলাটা)। এটি ডাল জাতীয় উদ্ভিদ পরিবার ঋধনধপবধব (ফ্যাবেসি) -এর সদস্য। মূলত মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, বিশেষ করে ব্রাজিল ও পেরু অঞ্চলে এর উৎপত্তি। পরে এটি আফ্রিকা ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ঔপনিবেশিক যুগে এটি ভারত ও শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে আসে- প্রথমে ঔষধি গাছ হিসেবে, পরে সৌন্দর্যের কারণে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
হোমনায় এই ফুলের চাষ হয় না। তবু প্রতি বছর স্টেডিয়াম পাড়া ও বাসস্ট্যান্ডের পাশে খালি পড়ে থাকা জায়গায় এই ফুলের বন তৈরি হয়। পাকা রাস্তায় হাঁটলে দুপাশে দেখা যায় লম্বা সবুজ ডাঁটির মাথায় শঙ্কু (কোণ) আকৃতির উজ্জ্বল হলুদ ফুল। দেখতে অনেকটা জ্বলা মোমবাতির মতো, তাই এর ইংরেজি নাম ‘ক্যান্ডেল বুশ’।
স্থানীয় বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, কেউ এই ফুল লাগাইনি, তবু প্রতিবছর এই সময়ে (বর্ষার পর) নিজেরাই জন্মায়। রোদে যখন ফুলগুলো ঝলমল করে, তখন মনে হয় পুরো জায়গাটা যেন সোনায় মোড়া। সাদেক ও খোকন মিয়ারও একই মত।
ওষুধি গুণে সমৃদ্ধ দাদমর্দন। দাদমর্দন শুধু চোখের আরাম নয়, এটি একটি বহুল পরিচিত ভেষজ উদ্ভিদ। এর পাতায় ও ফুলে রয়েছে অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও প্রদাহনাশক উপাদান।
জানা যায়, এর পাতা পিষে দাদ, চুলকানি, একজিমা ও চর্মরোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এজন্যই এর স্থানীয় নাম ‘দাদমর্দন’।
আয়ুর্বেদিক ও লোকজ চিকিৎসায় দাদমর্দন পাতার নির্যাসকে প্রাকৃতিক ছত্রাকনাশক হিসেবে ধরা হয়। এতে বিদ্যমান ‘ক্রাইসোফানল, রাইন ও অ্যালো-ইমোডিন’ (ঈযৎুংড়ঢ়যধহড়ষ, জযবরহ ও অষড়ব-বসড়ফরহ) যৌগ ত্বকের সংক্রমণ রোধে কার্যকর।
মানুষের মনে স্বর্ণালী ছোঁয়া ঃ বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে বা স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায় প্রতিদিন শত শত মানুষ যাতায়াত করে। অনেকের কাছে দাদমর্দনের এই হলুদ বন একরকম মানসিক প্রশান্তির জায়গা। প্রাতঃভ্রমণ কিংবা বৈকালিক ভ্রমণপ্রিয়রা প্রশান্তি নিয়ে দু’দণ্ড দাঁড়ান সেখানে।
পথচারী শামীমা আক্তার বলেন, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে যখন এই সোনালি ফুল দেখি, তখন মনটা হালকা লাগে। কোনো যত্ন-আত্তি ছাড়াই এত সুন্দর একটা জায়গা হতে পারে, এটা ভারা যায় না।
বিকেলের আলোয় এই ফুলের সারি আরও দীপ্ত হয়ে ওঠে। অনেকেই এখন এখানে ছবি তুলতে আসেন।
পরিবেশের জন্য উপকারী ঃ এই উদ্ভিদ মাটির ক্ষয় রোধে সহায়ক এবং মাটির নাইট্রোজেন স্থিতিশীল রাখে। হোমনার পতিত জমিতে দাদমর্দনের এই প্রাকৃতিক বৃদ্ধি স্থানীয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন স্থানীয় কৃষিবিদরা। গাছের পাতার ঘনত্ব মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সহায়তা করে, ফলে ওই জমিগুলো পুরোপুরি অনুর্বর হয়ে পড়ে না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং ফলজ, ঔষধি ও অর্নামেন্টাল গাছের উন্নয়ন, উৎপাদন ও সমপ্রসারণে কাজ করে থাকে। ঔষধিগুণ হিসেবে বর্তমানে এই ধরণের কোনো গবেষণা চলমান নাই। তবে ঔষধি গাছ হিসেবে দাদমর্দন সম্ভাবনাময় গাছ। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইং (উপজেলা কৃষি অফিস এবং জেলা অফিস সমূহ) শুধু মাঠ ফসল নিয়ে কাজ করে থাকে।
উপেক্ষিত সৌন্দর্যের প্রতীক
দাদমর্দনের পুরো জীবনচক্রই প্রকৃতির স্বাভাবিক ব্যবস্থার নিদর্শন। যত্ন না পেলে যেমন মরে যায় না, তেমনি অতিরিক্ত পরিচর্যায়ও টেকে না। এটি যেন বলে দেয়- প্রকৃতি নিজের মতো করে টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে।
হোমনার এই দাদমর্দন ফুলের বন সেই অপ্রচলিত সৌন্দর্যের প্রতীক, যা কোনো পরিকল্পনা বা বাগান প্রকল্প ছাড়াই গড়ে ওঠে। অথচ মানুষের মনে রঙ ছড়িয়ে দেয়। স্থানীয় প্রশাসন বা পৌর কর্তৃপক্ষ যদি জায়গাটিকে সামান্য পরিচর্যা ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়, তাহলে এটি সহজেই একটি প্রাকৃতিক ফুলবাগান বা প্রাতভ্রমণ ও বৈকালিক ভ্রমণকারীদের জন্য একটি অন্যতম আনন্দদায়ক স্পট হিসেবেও গড়ে উঠতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্ষেমালিকা চাকমা বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ প্রশাসনের অন্যতম অগ্রাধিকার। জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও স্থানীয় মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে আমরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তার ধারে বিভিন্ন প্রজাতির মৌসুমী ফুল ও ফলের চারা রোপণ কর্মসূচি পরিচালনা করি। যেখানে ওষুধি ও দেশীয় ফুলগাছকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। দাদমর্দন ফুলের মতো উদ্ভিদ শুধু পরিবেশ নয়, মানুষের স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই আমরা স্থানীয় কৃষি বিভাগ ও পরিবেশবান্ধব সংগঠনগুলোর সহযোগিতায় এসব গাছের সংরক্ষণ, চারা বিতরণ ও সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণের ইচ্ছা আছে।
পৌর প্রশাসক আহম্মেদ মোফাচ্ছের বলেন, পৌরসভা নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নে কাজ করছে। কমিউনিটি পার্টিসিপেশন কর্মসূচির আওতায় বিদ্যালয়, কলেজ, বাজার কমিটি ও সামাজিক সংগঠনকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। নাগরিকদের ফুল চাষ, সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যারা নিজ উদ্যোগে ফুল রোপণ ও পরিচর্যা করবেন, তাদের পুরস্কার বা কর ছাড়ের বিষয়ও বিবেচনায় আছে। শিশুদের গাছপ্রেমী করে তুলতে স্কুলে পরিবেশ সংগঠন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। নাগরিকদের রোপিত গাছের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও মনিটরিং ব্যবস্থাও থাকবে। দাদমর্দনসহ স্থানীয় ফুল ব্যবহারে শহরকে আরও সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব।
প্রকৃতির বার্তা
এই ফুল আমাদের মনে করিয়ে দেয়- যত অনাদরই হোক, প্রকৃতি নিজের সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখে না। শুধু তাকে বাঁচতে দিলে, সে নিজেই রাঙিয়ে দেয় চারপাশ।
হোমনার দাদমর্দন ফুলের বন তাই শুধু একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, এটি অবহেলায়ও বেঁচে থাকা জীবনের এক প্রতীক, এক নিঃশব্দ সৌন্দর্যের গল্প।