একসময় সকালে বালতি, হাঁড়ি হাতে নারী-পুরুষের পদচারণায় মুখর থাকত গ্রামের কুয়াপাড়ায় এমনকি শহরের অধিকাংশ বাসায় কুয়ার পানির প্রচলন ছিল। সূর্য উদয় হওয়ার সাথে সাথেই আলো উদয় হওয়ার পাড়া মহল্লার বৌ-ঝিঁয়ের হাসি, গল্প আর খুনসুটির কলরব মুখোরিত হত ইন্দ্রারপাড়। কেউ পানি তুলতো, কেউ অপেক্ষায় থাকতো পালা আসার-আর সেই ফাঁকে চলতো জীবনের গল্প। কুপ তখন শুধু পানির উৎস নয়, ছিল গ্রামের সামাজিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র।
আজ সেই কুপ-যেখান থেকে মানুষ শুধু পানি নয়, টানতো সম্পর্কের বন্ধনও-নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে কালের বিবর্তনে।
দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলার গ্রামীণ জনপদে একসময় প্রতিটি গৃহস্থ বাড়ির উঠোনে বা গ্রামের মাঝখানে দেখা যেত কুপ, ইন্দ্রিরা বা কুয়া। বিশুদ্ধ পানির আশায় খনন করা হতো এসব কুপ। রান্না, খাওয়া, গোসল, এমনকি কৃষিকাজেও ব্যবহার হতো এর পানি।
গ্রামীণ নারীরা সকাল-বিকেল হাঁড়ি-বালতি হাতে কুপে আসতেন। সেই সময়টা হয়ে উঠত হাসি-আড্ডার, খোঁজখবর নেওয়ার, মন খারাপ ভুলে যাওয়ার এক আশ্রয়। একেকটা কুপ ছিল যেন একেকটি ছোট সামাজিক মঞ্চ।
কিন্তু সময় বদলেছে। টিউবওয়েল, ডীপ টিউবওয়েল ও মোটরচালিত পানির সহজলভ্যতায় কুপের দরকার ফুরিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই কুপের নাম শুনেছে বইয়ে বা বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে, কিন্তু বাস্তবে কখনো চোখে দেখেনি।
বোচাগঞ্জ ও বীরগঞ্জ শহরের আশপাশের জনপদ থেকে শুরু করে দূরের প্রত্যন্ত গ্রামগুলো ঘুরে দেখা যায়-অল্প কিছু পুরোনো কুপ এখনো কোনোভাবে টিকে আছে সময়ের ধাক্কা সামলে। বোচাগঞ্জ উপজেলার ইশানিয়া গ্রামের মালিপাড়ার কুপটি ভেঙে পড়েছে অবহেলায়, আর বীরগঞ্জের পাল্টাপুর ইউনিয়নের কাজল গ্রামে দেখা মেলে পরিত্যক্ত এক কুপের। তবে অধিকাংশ কুপই আজ ভরাট হয়ে গেছে, কিছু ভেঙে পড়েছে অবহেলার কারণে, আর বাকিগুলো সময়ের ভারে হারিয়েছে তাদের ব্যবহারযোগ্যতা।
ইশানিয়া গ্রামের গৃহবধূ তাপসি রানী বলেন, “এই কুপ থেকেই একসময় আমাদের ঘরের সব কাজ চলত। এখন তা ভরাট হয়ে গেছে, নতুন প্রজন্ম জানেই না এখানে কুপ ছিল।”
স্থানীয় প্রবীণ মো. মফির উদ্দিন (৭৩) স্মৃতিচারণা করে বলেন, “কুপ একসময় ছিল জীবনের অংশ। পুকুর বা নদী-নালা দূষিত হলে কুপের পানিই ছিল ভরসা।
সেতাবগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি মাসুদ বলেন, “আমাদের গ্রামে এক সময় কুয়ার পানি ছিল সবার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই কুয়া ঘিরে চলত গ্রামের মানুষের পানাহার, সামাজিক আড্ডা ও সৌর্হাদ্যের পরিবেশ। কিন্তু আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সেই কুয়ার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। একদিকে অব্যবহার, অন্যদিকে যথাযথ সংরক্ষণের অভাব-সব মিলিয়ে কুয়ার চারপাশে মাটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে, পানি শুকিয়ে যাচ্ছে, কেউ আগের মতো যত্ন নিচ্ছে না।