দেশজুড়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন মেঝেতে হাজার হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। বছরে এর পরিমাণ অর্ধকোটিরও বেশি। তাছাড়া শয্যার অভাবে দিনে আরো কয়েক হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে না। যদিও গত পাঁচ বছরে দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু তাতেও কাটছে না হাসপাতালের শয্যাসংকট। শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই দিনে মেঝেতে চিকিৎসা নেয় গড়ে দুই হাজার রোগী। একই চিত্র ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। তার বাইরে বিভাগীয় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গড়ে এক হাজার ৫০০ রোগী এবং অন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে গড়ে এক হাজার রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নেয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, হাসপাতালের করিডর বা মেঝেতে থাকা রোগীদের রোগজীবাণুতে সংক্রমণের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কারণ করিডর বা মেঝে ফাঁকা না থাকায় বেশির ভাগ সময় জীবাণুমুক্ত করা হয় না। তাতে এক রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে রোগী অন্য রোগ নিয়ে বাড়ি ফিরছে। তাতে রোগীকে অধিক সময় হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে এবং বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়ও। কারণ করিডর বা মেঝেতে থাকা রোগী নানাভাবে স্বাস্থ্যকর্মী ও দর্শনার্থীর সংক্রমিত হাত এবং কাছাকাছি থাকা রোগীদের মধ্যে সরাসরি সংস্পর্শ, সংক্রমিত মেঝের কাছাকাছি থাকা এবং সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত না হওয়া ট্রলি, চেয়ার বা সরঞ্জাম থেকে হাসপাতালে থাকা (নোসোকোমিয়াল ইনফেকশন) জীবাণু (এমআরএসএ, ইএসবিএল) সহজেই সংক্রমণ ঘটায়। তাছাড়া করিডরে বায়ু চলাচল ব্যবস্থা ভালো না থাকায় শ্বাসতন্ত্রের জীবাণু সহজেই এক রোগী থেকে অন্য রোগীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আবার হাসপাতালের ওসব জীবাণু প্রায়ই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়। ফলে রোগীর গুরুতর ইনফেকশন, আইসিইউ সাপোর্ট এবং মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। রোগীর নিরাপত্তা এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে এই প্রথা বন্ধ করা প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ৭১ হাজার ৬৬০টি। বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ৯৯ হাজার ৯৭৫টি। মোট শয্যা এক লাখ ৭১ হাজার ৬৭৫টি। কিন্তু দেশের অন্তত ২০টি জেলায় প্রতি ১০ হাজার বাসিন্দার জন্য স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে গড়ে দুটি শয্যাও বরাদ্দ নেই। তার মধ্যে শেরপুরে সবচেয়ে কম ১.৩০। লক্ষ্ণীপুরে ১.৪৪, পরের অবস্থানে নরসিংদী ১.৪৯, হবিগঞ্জে ১.৫০, গাজীপুরে ১.৫৬, সিরাজগঞ্জে ১.৫৮, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১.৬১, নাটোরে ১.৬২, গাইবান্ধায় ১.৬৩ ও চুয়াডাঙ্গায় ১.৬৬। দুর্বল প্রাথমিক চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার অভাবে জীবনহানি, রোগ বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে। সেক্ষেত্রে শয্যা বাড়ানো কোনো সমাধান নয়। কারণ কোথাও শয্যা ফাঁকা থাকছে, কোথাও শয্যাসংকটে মেঝেতেও রোগীর জায়গা হচ্ছে না। তাতে চিকিৎসা নিতে এসে রোগী ও রোগীর আত্মীয়রা সংক্রমিত হচ্ছে। বাদ পড়ছেন না চিকিৎসক ও নার্সরাও। তাই প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও প্রাথমিক সেবায় জোর দেয়া জরুরি।
সূত্র আরো জানায়, সরকারের সারা দেশে ২১ হাজার ৪১১টি স্বাস্থ্যবিষয়ক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার মধ্যে রোগী ভর্তির সুবিধাসহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জেলা বা জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ সরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল আছে ৬৬০টি। আর দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা সাত হাজার ৮৫৪টি এবং বেসরকারি রোগ নিরীক্ষাকেন্দ্র প্রায় ১০ হাজার। ব্লাড ব্যাংক ১৮০টি। তবে গত পাঁচ বছরে সরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যাসংখ্যা ৩৫ হাজার থেকে প্রায় ৭২ হাজার হয়েছে। জেলা সদর হাসপাতাল ৫০ থেকে ২৫০ শয্যা এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। তাছাড়া অন্য সব হাসপাতালে শয্যা বেড়েছে। আইসিইউ শয্যাসংখ্যা ৩৮১ থেকে এক হাজার ৮৬০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ উপজেলা হাসপাতালে সারা বছরই শয্যা ফাঁকা থাকছে। বেশির ভাগ রোগীর চাপ বড় শহর ও ঢাকার হাসপাতালগুলোতে তৈরি হচ্ছে। এদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। সারা দেশের রোগী ঢাকার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসে। অথচ উপজেলা হাসপাতালে বেশির ভাগ সময় শয্যা ফাঁকা থাকছে।
এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অতীতে বাংলাদেশ কিছু রোগ নির্মূল করেছে, কিছু রোগ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। তার মধ্যে ফাইলেরিয়া বা গোদরোগ, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ, জলাতঙ্ক রয়েছে। প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছে। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা তিন স্তরের হওয়া প্রয়োজন। যাতে ৮০ শতাংশ মানুষকে ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। জেলা পর্যায়ে ৯৫ শতাংশ মানুষের সেবা নিশ্চিত করা এবং গুরুতর ৫ শতাংশ রোগী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া। তবেই শয্যার সংকট কমবে।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করে দেয়া স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না। বরং ৭০ শতাংশ চিকিৎসা সেবা বেসরকারি খাতে চলে গেছে। এ থেকে জাতিকে রক্ষা করতে অবশ্যই সরকারি খাতের গুরুত্ব দেয়া জরুরি। তার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাগুলোকে কতগুলো অর্থনৈতিক বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানান, দিনে ১৫ হাজার মানুষ হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নেয়। ওই হিসাবে বছরে মেঝেতে চিকিৎসা নেয় প্রায় ৫৪ লাখ ৩৫ হাজার রোগী। শয্যার অভাবে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে না আরো অন্তত ১০ লাখ রোগী। ফলে আরো ১৫ হাজার শয্যা বাড়ানো ছাড়া মানসম্পন্ন চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়। সেজন্য অতিদ্রুত ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও তা বাস্তবায়নে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে।