রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌর বাজারের মরহুম হাসনা হেনা ও শামসুল হুদা দম্পতির ১২ সন্তান উচ্চ শিক্ষার পর সফল হয়েছেন। তারা সবাই উচ্চ পর্যায়ের চাকরীজীবী। তবে এরমধ্যে কেউ কেউ অবসর গ্রহণ করেছেন। হাসনা হেনা ও শামসুল হুদা দম্পতির ১২ সন্তানের জন্মই শুধু দেননি। তাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে সমাজের সম্মানজনক স্থানে জায়গায়ও করে দিয়েছেন। তাঁদের সব সন্তানই চাকরীজীবী। তাদের মধ্যে অধিকাংশই সরকারী কর্মকর্তা। বড় ছেলে ওয়ালী আহাদ বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে পারমানবিক গবেষনার উচ্চ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে দীর্ঘদিন চাকরী শেষে অবসর গ্রহনের পর বেসরকারী একটি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করছেন। দ্বিতীয় সন্তান ফখরুল ইসলাম জনতা ব্যাংকের এজিএম ছিলেন তিনি ২০২৩ সালের ২৩ জুন হার্ডস্টোকে মৃত্যু হয়। তৃতীয় সন্তান জহুরুল ইসলাম সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, চতুর্থ সন্তান মারিউল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে সম্মান শ্রেনীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মারাত্বক অসুস্থ হয়ে মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে বর্তমানে বাড়িতে অবস্থান, ৫ম সন্তান রাবিউল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালল থেকে মাস্টার্সের পর এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষক, ৬ষ্ঠ সন্তান মাহফুজুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে অনার্সসহ মাস্টারস শেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, ৭ম সন্তান বড় মেয়ে তহমিনা খাতুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে বর্তমানে গৃহিনী, ৮ম মেয়ে মাসুমা খাতুন জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার, ৯ম মেয়ে নাছিমা খাতুন হিরা সরকারি কলেজ শিক্ষক, তিনি ২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারী মৃত্যু বরণ করেন। ১০ সন্তান ফরিদা পারভীন দিনাজপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সহযোগী অধ্যাপক, ১১ তম সন্তান মোর্শেদা নাজনীন ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সহযোগী অধ্যাপক এবং সর্বশেষ ১২ তম মেয়ে নীলা হাফিয়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা পদে কর্মরত। একারনেই ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারী স্থানীয় এলাকাবাসী আনুষ্ঠানিকভাবে রত্নগর্ভার খেতাবে ভুষিত করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালিন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার শফিউল আলম। স্বল্প আয়ের শিক্ষক মরহুম শামসুল হুদা এতোগুলো ছেলে-মেয়ের পড়া লেখার খরচ চালাতে যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন হাসনা হেনা তাকে সাহস যুগিয়েছেন। দিয়েছেন প্রেরণা। স্বামীকে বাড়তি আয়ের জন্য টিউশনি করতে পরামর্শের পাশাপাশি নিজে বাড়িতে মুরগী-ছাগল পুষতেন। বাড়ির আঙ্গিনায় শাক-সবজি চাষ আর বাতাবি লেবুর গাছ লাগিয়ে সময়ে-অসময়ে সেগুলো বিক্রি করে তিনি সন্তানদের লেখা পড়ার খরচে সহযোগীতা করতেন। কখনও খেয়ে কখনও বা না খেয়েই সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের টাকা পাঠাতেন। ১৯৯৩ সালের ১৬ আগষ্ট শিক্ষক শামসুল হুদার মৃত্যুর পর হাসনা হেনা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েন। বড় ছেলের চাকরী হলেও বাঁকিগুলোর অনেকের চাকরি, কারও লেখা-পড়া শেষ করানো এ চিন্তা যেন হাসনা হেনাকে তাড়া করে ফেরে। আত্মীয়দের বাড়িতে ধার-কর্য করে আর ছেলেমেয়েদের বাড়তি টিউশনি। সন্তানদের সবাই তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ায় চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন এবং সমাজের সম্মানজনক জায়গায় স্থান করে নেন। হাসনা হেনার সব সন্তান প্রতিষ্টিত হওয়ার পর ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন। জানা গেছে, মরহুম শিক্ষক শামসুল হুদা জন্ম অবিভক্ত ভারতবর্ষের মুর্শিদাবাদের লালগোলায়। পিতার নাম মকছেদ আলী পন্ডিত। মাত্র ৮ বছর বয়সে তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় হাসনা হেনাকে। একই এলাকার পাশ্ববর্তী পাড়ার মৃত সাদির শেখের ছেলে শামসুল হুদার সংগে বিয়ে হয় তাঁর। ১৯৪৩ সালের দিকে স্বামীর চাকরি সুত্রে বর্তমান ঠিকানা রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার আড়ানীতে আগমন। সেই সুত্রে এখানেই স্থায়ী বাস। স্বামী শামসুল হুদা ছিলেন দেড়শ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ আড়ানী মনোমোহিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। স্বামীর কাছেই পড়ালেখা শেখা তাঁর। দশম শ্রেনী পর্যন্ত পড়া-লেখা করেছেন হাসনা হেনা। বাল্যবিয়ের কারনে হাসনা হেনাকে ছোটবেলা থেকেই জীবন যুদ্ধে অবতীর্ন হতে হয়। শিক্ষক হুদা ছাত্রদের মাঝে যখন মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন। তখন হাসনা হেনাকেও সেই দিকেই মনোনিবেশ করতে হয়। সে সময় জাইগির প্রথা থাকায় ভাল ছাত্রদের নিজের বাড়িতে রাখতেন শিক্ষক হুদা। আর সেই ছাত্রের খাওয়া-দাওয়া, নিয়মিত পড়ালেখার দিকে নজর দিতে হতো হাসনা হেনাকে। এরই মাঝে কোল জুড়ে আসে হাসনা হেনার বড় সন্তান ওয়ালী আহাদ। তাকেও তিনি লেখা পড়া শেখান। এভাবেই একে একে বারোটি সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এর মধ্যে ছয়টি ছেলে আর ছয়টি মেয়ে।