উপকূলীয় জনপদ খুলনা জেলার কয়রার মানুষ বারবার দুর্যোগে কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শত বাধা পেরিয়ে আবারও উঠে দাঁড়ায়। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের পর তারা ঘর তোলে, বীজ বোনে, আবার নতুন করে বাঁচতে শেখে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেলেও হার মানে না উপকূলের মানুষ। তারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল আজ শুধু দুর্যোগের গল্প নয়- এটি টিকে থাকা ও অভিযোজনের লড়াই আর আশার প্রতীক। এক কথায় দক্ষিণাঞ্চলের এই উপকূল যেন প্রকৃতির পরীক্ষাগার। কয়রা উপজেলায় ৩ লক্ষ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে প্রতিনিয়ত দুর্যোগ ঝুকিতে রয়েছে ১ লাখ মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ভোলা ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালের বন্যা, ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলা, আর ২০২০ সালের আম্পান- প্রতিটি দুর্যোগই খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষের জীবন ও জীবিকায় গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। আইলা ও আম্পানের ক্ষয়ক্ষতিতে শুধু খুলনা-সাতক্ষীরার উপকূলে প্রায় ৫০ হাজার পরিবার বাস্তচ্যুত হয়েছে। চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে ২৫ হাজার হেক্টর কৃষিজমি- যেখানে এখন চাষ হয় লবণাক্ততা আর বেকারত্বের। কয়রা উপজেলার কাটকাটা লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা তাজমিনুর ইসলাম বলেন, কয়রায় বেড়িবাঁধ আছে, কিন্তু টেকে না। আমরা প্রতি বছর বাঁধ দেখি, আবার তা ভেঙে যেতেও দেখি। মাটি কেটে তাড়াহুড়ো করে দিলে সেটা তো টিকবে না। সামান্য বৃষ্টি আর জোয়ারের পানি আসলেই সব শেষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড যেভাবে বাঁধ দিচ্ছে, তা অনেকেই আস্থাহীন বলছেন। কারণ বাঁধের ঠিক পাশ ঘেঁষে নদীর প্রবল জোয়ারের তোড়ে কপোতাক্ষ নদ এখন কাশীর হাটখোলা খেয়াঘাট থেকে সাতক্ষীরার গাবুরা পর্যন্ত নতুন চর তৈরি করছে। নদীর বাঁক পরিবর্তন হয়ে কয়রার মূল অংশে হুমকি তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন হয়তো কয়রা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তখন চারদিক ঘেরা নদী, ওপারে ঘন সুন্দরবন- মাঝখানে এক দ্বীপপ্রাম। মানুষের জীবন তখন নদী আর বনের মাঝখানে বন্দি হয়ে যাবে। ২৮ হাজার মানুষের সেই জনপদ হারাতে পারে কৃষিজমি, মৎস্য ঘের, এমনকি স্থল যোগাযোগের সুযোগও। স্কুলে যাওয়া শিশুরা নৌকায় চড়ে পার হবে, বাজার-হাসপাতাল হবে দূরের স্বপ্ন। নদীর ওপারে বাঘ, কুমির, আর ভেতরে মানবজীবনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়। দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা রফিউন নেসা বলেন, ‘আমরা নদীর সঙ্গে লড়াই করতে শিখেছি, কিন্তু নদী এখন আমাদের ঘরে ঢ়ুকে পড়েছে। ঘর ঠিক করতে গিয়ে সারাজীবন পার হয়ে যাচ্ছে।’সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এই উপকূলের মানুষ জানে- বাঁচতে হলে লড়তে হবে। তাই তারা আবারও বীজ বোনে, নৌকা বানায়, বাঁধ মেরামত করে। কিন্তু প্রকৃতির রুদ্রতায় হারিয়ে যায় তাদের পরিশ্রমের ফসল, ঘর, জমি- তবুও তারা থামে না। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি হারিয়ে উপকূলের বহু মানুষ এখন শহরমুখী। কৃষক হচ্ছেন রিকশাচালক, মৎস্যজীবী হচ্ছেন দিনমজুর- ফলে ভেঙে পড়ছে গ্রামীণ অর্থনীতি, বাড়ছে সামাজিক বৈষম্য। তবে আশার আলোও রয়েছে। সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্যোগে বেড়িবাঁধ সংস্কার, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, লবণসহনশীল ফসল ও জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রশিক্ষণসহ নানা কর্মসূচি গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নারীরাও এ প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীওে যুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। কয়রার কপোতাক্ষ কলেজের সাবেক অধ্যাপক আ, ব,ম আঃ মালেক বলেন, সুন্দরবনসংলগ্ন মানুষের আয়ের প্রধান উৎস এখনো বননির্ভর- মধু, গোলপাতা বা মাছ-কাঁকড়া আহরণ। কিন্তু সেখানে জেলেরা নানা শোষণের শিকার। স্থানীয়ভাবে কোম্পানি বা মালিক নামে পরিচিত দাদনদাতাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তারা বনে যায়। তাদেরকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করতে পারলে তারা কিছুটা হলেও উপকৃত হবে।
বনের ওপর নির্ভরশীল জেলে জোড়শিং গ্রামের মিজানুর রহমান বলেন, জুন-আগস্ট তিন মাসে বনাঞ্চলে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও ঐ সময় বিষ দিয়ে মাছ ধরায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বনের প্রাণবৈচিত্র। স্থানীয়দের মতে, দুর্যোগের পাশাপাশি এ শোষণও এখন উপকূলের মানুষের আরেকটি বড় দুর্যোগ। বেসরকারি সংস্থা জেজেএসের সহকারি প্রকল্প সমন্বয়কারী নাজমুল হুদা বলেন, জেজেএস, জাপানী সংস্থা শাপলা নীড়ের সহযোগিতায় কয়রা উপজেলার কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নে জেন্ডার সংবেদনশীল দুযোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শক্তিশালী করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রমের পাশাপাশি সাইক্লোন শেল্টারের ১০ কিঃ মিঃ কাঁচা সংযোগ সড়ক নির্মান, নলকূপের পাটাতন উচ্চকরণ, রাস্তার পাশে বৃক্ষ রোপন, ১৫ হাজার কেজি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন রেইন ওয়াটার নির্মান ৫৪ টি স্ইাক্লোন শেল্টারে পানির ব্যবস্থা করা ও দুর্যোগ সহনশীল টয়টেল নির্মান বাস্তবায়ন করছে। কয়রা উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার মোঃ মামুনার রশিদ বলেন, দুর্যোগে মানুষকে সচেতন করতে সরকারি ভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করা হচ্ছে।