কমিশন বাণিজ্য বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার নীরব ধ্বংস

মো : শামীম মিয়া | প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর, ২০২৫, ০৫:২৯ পিএম
কমিশন বাণিজ্য বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার নীরব ধ্বংস
মো : শামীম মিয়া

বাংলাদেশের চিকিৎসা খাত বর্তমানে এক ভয়াবহ নৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। যেখানে একসময় চিকিৎসা পেশা ছিল মানুষের জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতার নিদর্শন, আজ তা পরিণত হয়েছে আর্থিক লেনদেনের নিকৃষ্টতম প্রক্রিয়ায়। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশনগুলো একত্রে এমন এক অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে যা রোগীকে শুধুমাত্র আর্থিক বোঝা হিসেবে গণ্য করে। এই কমিশন ভিত্তিক বাণিজ্য কেবল রোগীর আর্থিক ক্ষতি করছে না, বরং এটি চিকিৎসক সমাজের নৈতিক মর্যাদা, জনসাধারণের আস্থা এবং রাষ্ট্রীয় নৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করছে।

চিকিৎসা পেশার অন্তর্নিহিত নীতি হলো রোগীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার নিশ্চয়তা প্রদান। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায়, এই নীতি ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। রোগীর রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা পরামর্শ প্রক্রিয়ায় কমিশন এবং আর্থিক প্রলোভনের প্রভাব এতটাই প্রবল যে চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত প্রায়শই রোগীর স্বাস্থ্যগত প্রয়োজনীয়তার পরিবর্তে অর্থনৈতিক প্রভাবের ভিত্তিতে গৃহীত হয়। ডাক্তারদের অগণিত সংখ্যক প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সংযোজন, অতিরিক্ত টেস্ট ও নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী প্রেরণ-সবই এখন একটি ব্যাবসায়িক হিসাবের অংশ। এভাবে রোগীর শরীর এবং অর্থ, দু’ই হয়ে উঠছে বাজারজাত পণ্যে।

ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো কমিশন বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। এখানে সেন্টারের মালিক এবং চিকিৎসকরা নির্দিষ্ট কমিশন হার নির্ধারণ করে দেন, যার উপর ভিত্তি করে ডাক্তার রোগীকে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠান। এই চক্রের মধ্য দিয়ে রোগীকে বারবার টেস্ট করানো হয়, যা শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতির কারণ নয়, বরং রোগীর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, আল্ট্রাসনোগ্রাফি-অনেক টেস্টের প্রয়োজন নেই, তবু কমিশনের কারণে করা হয়। এটি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অদক্ষতার এক প্রকট চিত্র।

ওষুধ শিল্পও এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানি ডাক্তারদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের প্রভাবিত করে-বিদেশ ভ্রমণ, ল্যাপটপ, গাড়ি, নগদ অর্থ, বা মাসিক কমিশন। ফলে ডাক্তাররা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। রোগীর সুস্থতার ওপর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভয়াবহ। স্বাস্থ্যখাতের আর্থিক ক্ষতিও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। প্রতিবছর প্রায় ২০ু২৫% ওষুধ বিক্রি অপ্রয়োজনীয়ভাবে হয়, যার মূল দায়ী কমিশন সংস্কৃতি।

কমিশন বাণিজ্যের সামাজিক ও নৈতিক প্রভাবও ভয়াবহ। চিকিৎসকরা একসময় ছিল শ্রদ্ধেয় পেশাজীবী; আজ মানুষ তাদের সন্দেহের চোখে দেখে। রোগীর আস্থা হারালে সমাজের নৈতিক কাঠামোও দুর্বল হয়ে পড়ে। চিকিৎসা পেশার মধ্যে মানবিকতা, সততা ও নৈতিকতার অভাব দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থা ক্ষয় করে, যা সামাজিক অস্থিরতার সূচনা করতে পারে।

এই প্রক্রিয়া টিকে থাকার মূল কারণ তিনটি-লাভের প্রলোভন, আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং সামাজিক নীরবতা। ডাক্তারদের মধ্যে অনেকে কমিশন গ্রহণকে অপরাধ মনে করেন না, এবং রোগীর সচেতনতা কম থাকায় তারা প্রতিবাদও করতে পারে না। সরকারের কার্যকর নজরদারি এবং কঠোর আইন না থাকায় এই চক্র অক্ষত রয়েছে।

অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতেও ক্ষতি প্রকট। স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১.২ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হয়, যার অন্তত ২০ু২৫% অর্থ সরাসরি কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে অপচয় হয়। এ অর্থ দিয়ে সরকারের অগণিত হাসপাতালে চিকিৎসা সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব, চিকিৎসা খাতে মৌলিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব, কিন্তু এই অর্থ এখন কিছু ব্যক্তির ব্যক্তিগত লাভে বিন্যস্ত হচ্ছে।

রোগীর দৃষ্টিকোণ থেকেও ক্ষতি বিরাট। গ্রামের দরিদ্র মানুষ হাসপাতালের চেম্বারে ঢোকার আগে ভয়ে কাঁপেন। কারণ তারা জানে, টেস্ট, প্রেসক্রিপশন, ওষুধ-সবই হয়তো অপ্রয়োজনীয়, কেবল কমিশনের জন্য। এক ব্যক্তি তার অল্প আয়ের টাকায় রোগ সারানোর চেষ্টা করছে, আর ডাক্তার বা হাসপাতাল সেটিকে তাদের আর্থিক সুবিধার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এমন অবস্থা মানবিকতার শিকড়কে ভেঙে দিচ্ছে। চিকিৎসক সমাজের মধ্যেও বিভাজন দৃশ্যমান। নৈতিক চিকিৎসকরা যেখানে রোগীর কল্যাণে কাজ করেন, অন্যদিকে কমিশনভিত্তিক চিকিৎসকরা আর্থিক স্বার্থে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই দ্বন্দ্ব চিকিৎসা পেশার প্রতি জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন করছে। সমাজের কাছে ডাক্তাররা আর শ্রদ্ধেয় নয়; তারা সন্দেহের প্রতীক। এই অবিশ্বাস শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নয়, জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলে।

সরকারি হাসপাতালের অবকাঠামোগত দুর্বলতা এই পরিস্থিতিকে আরও তীব্র করেছে। সরকারি চিকিৎসা সেবা যখন পর্যাপ্ত নয়, মানুষ বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কমিশন বাণিজ্য চক্রের আধিপত্য রয়েছে। রোগীরা এক ধরনের দ্বৈত শোষণের ফাঁদে পড়ছেন-সরকারি স্থানে কম সেবা, বেসরকারিতে অতিরিক্ত খরচ।

এই সমস্যা সমাধানে নৈতিক পুনর্জাগরণ, আইন প্রণয়ন, স্বচ্ছতা এবং সচেতন রোগী সমাজ অপরিহার্য। চিকিৎসকদের নৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, ওষুধ কোম্পানি ও হাসপাতালের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং রোগীদের শিক্ষিত করা-এসব পদক্ষেপ কমিশন সংস্কৃতিকে নির্মূল করতে সহায়ক। আইনগতভাবে, একটি স্বতন্ত্র ‘চিকিৎসা নৈতিকতা ও কমিশন পর্যবেক্ষণ বোর্ড’ গঠন প্রয়োজন। যা নিয়মিত তদন্ত, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রকাশযোগ্য প্রতিবেদন দেবে। সরকারি হাসপাতালের মানোন্নয়নও জরুরি। যদি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেবার মান বৃদ্ধি পায়, জনগণ বাধ্য হবে না বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেতে। চিকিৎসা পেশা শুধু একটি কাজ নয়; এটি মানুষের জীবন, নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং সামাজিক আস্থার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কমিশন বাণিজ্য এই পবিত্র স্থানকে অক্ষুণ্ন রাখার পরিবর্তে ভেঙে দিচ্ছে। আজ যদি আমরা কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, এটি কেবল স্বাস্থ্যখাত নয়, রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকেও ধ্বংসের সূচনা করবে। চিকিৎসা হবে মানুষের অধিকার, অর্থের নয়-এটি নিশ্চিত করা ছাড়া ভবিষ্যৎ অসম্ভব।

রোগী, ডাক্তার, প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র-সবারই অব্যাহতি নেই। জনগণকে সচেতন হতে হবে, ডাক্তারদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হবে, হাসপাতাল ও কোম্পানিকে স্বচ্ছ হতে হবে, এবং রাষ্ট্রকে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। একমাত্র এভাবে আমরা বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার নৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করতে পারব। চিকিৎসা পেশা যদি মানুষের কল্যাণকে কেন্দ্রে রাখে, যদি কমিশনের লোভকে পরাভূত করা যায়, তাহলে সমাজে নতুন আস্থা, নতুন আশা এবং নতুন স্বাস্থ্য সংস্কৃতি জন্মাবে। নৈতিকতা ও মানবিকতা ফিরে এলে চিকিৎসা হবে সত্যিই সেবা, আর রোগী পাবেন যে মর্যাদা তার জীবন এবং স্বাস্থ্য অনুযায়ী প্রাপ্য।

লেখক: মো: শামীম মিয়া; কলামিস্ট