ন্যায়বিচার কায়েম করতে হলে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী কাজ করে সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে

এফএনএস (এম এ আজিম; খুলনা) : | প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর, ২০২৫, ০৫:২৬ পিএম
ন্যায়বিচার কায়েম করতে হলে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী কাজ করে সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে

খুলনায় ইমাম সম্মেলনে বক্তারা বলেছেন, মসজিদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম এবং সমাজ থেকে সকল জুলুম উৎখাত করে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ইমামদের ভূমিকা রাখতে হবে। সমাজ থেকে জুলুম উৎখাত ও ন্যায়বিচার কায়েম করতে হলে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী কাজ করে সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে।

বক্তারা আরো বলেন, ইমামদের কাছে মসজিদ ও মেহরাব একটি বড় আমানত। রাসূল (সা:) সকল সামাজিক কর্মকান্ড মসজিদ থেকেই আঞ্জাম দিয়েছেন। সুতরাং মসজিদকে কেন্দ্র করে প্রতিটি এলাকা তৈরি করতে পারলে এবং এলাকার সকল মুসলমান নামাজি হলে তারা কুরআন হাদিসের বিধি-বিধান মেনে চলবে। আর এর মধ্য দিয়ে সমাজে ন্যায় বিচার, ইনসাফ ও শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হবে। একই সঙ্গে ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী নেতৃত্ব তৈরি এবং পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মসজিদ পরিচালনা কমিটিকে সংস্কার করে মসজিদে নববীর অনুকরণে মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে ইমামদের দায়িত্ব পালনের ওপরও জোরদেন আলেম-ওলামারা। 

শনিবার (২৫ অক্টোবর) সকাল ১০টায় খুলনার সার্কিট হাউজ ময়দানে 'সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি-শৃঙ্খলা, সম্প্রীতি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ইমামদের ভূমিকা' শীর্ষক ইমাম সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন। খুলনা জেলা ইমাম পরিষদ এ সম্মেলনের আয়োজন করে। 

ইমাম সম্মেলনে মুসলমানদের ঈমান আকীদা হেফাযত এবং আমল আখলাক সংশোধন করার লক্ষ্যে ইমামদেরকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন, মুসলিম উম্মাহর ক্রান্তিকালে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে সঠিক পথের দিশা দেওয়া এবং মুসলিম উম্মাহকে হক্কের পক্ষে ও বাতিলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে  মসজিদকে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করাসহ দশ দফা প্রস্তাব ও দাবী পেশ করা হয়। 

সম্মেলনে প্রধান বক্তা ছিলেন, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা মুহিবুল্লাহিল বাকি আন নদভি। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী মহাপরিচালক আল্লামা মুফতি জসিম উদদীন। সভাপতিত্ব ও উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন খুলনা জেলা ইমাম পরিষদের সভাপতি মাওলানা মোহাম্মাদ সালেহ। সম্মেলনে ১০ দফা প্রস্তাব ও দাবি উপস্থাপন করেন খুলনা জেলা ইমাম পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তালিমুল মিল্লাত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা এ এফ এম নাজমুস সউদ। আর্থিক রিপোর্ট পেশ করেন অর্থ সম্পাদক হাফেজ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ।

সম্মেলনে প্রধান বক্তার বক্তব্যে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা মুহিবুল্লাহিল বাকী আন নদভি বলেন, ভালো কাজ করা কঠিন, আর চুরি-চামারি, সুদ- ঘুষ খাওয়া সহজ। এ সমাজে ইমামদের প্রতিটি পদক্ষেপে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তাদেরকে ইমামের দায়িত্ব পালন করতে হয়। যারা ইমামদের বিরোধিতা করে তারাও বিপদে পড়লে ইমামদের কাছেই দোয়ার জন্য আসে।

তিনি আরও বলেন, বিগত দিনে অনেকেই চোখের পানিও ফেলতে পারেননি। তার মধ্যে অনেক চোখের পানির বিনিময়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ দেশে ইসলাম কায়েমের পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছেন। সুতরাং চোখের পানি চালু রাখতে হবে। আমাদের কোন অহংকারের কারণে চোখের পানি ফেলা যেন বন্ধ না হয়ে যায়।

তিনি বলেন, ইয়াহুদীদের ষড়যন্ত্রের কারণে ইমামদের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে। এ বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। একই সঙ্গে তিনি ইমাম ও আলেম-ওলামাদের একে অপরের বিরুদ্ধে না যাওয়ার আহবান জানিয়ে এবং চাকরির পরোয়া না করে রিজিকের জন্য আল্লাহর ওপর নির্ভর করার আহবান জানান।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী মহাপরিচালক আল্লামা মুফতি জসীম উদদীন বলেন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাই যার যার হক আদায় করলে সবকিছুই সঠিক ভাবে চলবে এবং সর্বত্র শান্তি বিরাজ করবে।

তিনি বলেন, ইমামরা উম্মতের পথ প্রদর্শক। নিজেরা সম্পূর্ণভাবে পরিশুদ্ধ হলে সমাজও পরিশুদ্ধ হবে। এভাবেই সমাজে ইমামতে সুগরা থেকে রাষ্ট্রে ইমামতে কুবরায় পরিণত হবে। একই সঙ্গে তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদসহ প্রত্যেককে দ্বীনের পথে আনতে ইমামদের প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান।

ইমামদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, নিজেরা নিজেদের মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলে অন্যরাও সম্মান দিবে। একই সঙ্গে যারা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে ষড়যন্ত্র করছে তাদের ব্যাপারে উম্মতকে বোঝানোর আহ্বান জানান তিনি। বিশেষ করে ইসকন ও কাদিয়ানীদের ব্যাপারে ইমামদের সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি মুসলমানদের সন্তানদের কুরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত করার মধ্য দিয়ে পরিবার, মহল্লা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইসলামের প্রসার ঘটাতে ইমামদের মনোবল বৃদ্ধির আহ্বান জানান।

মাওলানা জাফর সাদিক ও মুফতি আসাদুজ্জামানের পরিচালনায় ইমাম সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন খুলনা জেলা ইমাম পরিষদের সহ-সভাপতি যথাক্রমে হাফেজ মাওলানা মুশতাক আহমাদ, অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুর রহমান, অধ্যক্ষ মাওলানা রহমাতুল্লাহ, হাফেজ মাওলানা আব্দুল আউয়াল, মাওলানা আসাদুল্লাহ, মাওলানা মোশাররফ হুসাইন, সাধারণ সম্পাদক মাওলানা গোলাম কিবরিয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাওলানা নাসিরুদ্দিন কাসেমী, সহ সাধারণ সম্পাদক মুফতি জিহাদুল ইসলাম, আইন বিচার ও ফতোয়া বিষয়ক সম্পাদক মুফতি গোলামুর রহমান, শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মসজিদ মিশন খুলনার সভাপতি অধ্যাপক মাওলানা আ,ন, ম আব্দুল কুদ্দুস, জেলা ইমাম পরিষদের দাকোপ থানা সভাপতি অধ্যক্ষ মাওলানা অজিয়ার রহমান, কয়রা থানা সভাপতি মাওলানা মিজানুর রহমান, তেরখাদা থানা সভাপতি মাওলানা আব্বাস আলী, পাইকগাছা থানা সভাপতি মুফতি কুদরত উল্লাহ কাসেমী, সোনাডাঙ্গা থানা শাখার সহ-সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ, বটিয়াঘাটা থানা সভাপতি মুফতি শহিদুল ইসলাম, খালিশপুর থানার সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাওলানা আবু সালেহ, খুলনা সদর থানা সভাপতি মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান, খানজাহান আলী থানা সভাপতি মাওলানা রফিকুল ইসলাম, রূপসা থানা সভাপতি মাওলানা হেকমত আলী, ডুমুরিয়া থানা সাধারণ সম্পাদক মুফতি আব্দুর রহমানসহ খুলনা মহানগর ও জেলার বিভিন্ন থানা ও উপজেলা সভাপতি এবং প্রতিনিধি। 

সম্মেলনে পেশকৃত ১০ দফা প্রস্তাব ও দাবিগুলো হচ্ছে- মুসলমানদের ঈমান আকীদা হেফাযত এবং আমল আখলাক সংশোধন করার লক্ষ্যে রসূলুল্লাহ (সা:) এর উত্তরসূরী হিসেবে ইমামদেরকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে, মুসলিম উম্মাহর ক্রান্তিকালে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে সঠিক পথের দিশা দেয়ার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে, মুসলিম উম্মাহকে হক্কের পক্ষে ও বাতিলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং মসজিদকে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে, পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মসজিদ পরিচালনা কমিটিকে সংস্কার করে মসজিদে নববীর অনুকরণে মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে ইমামদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ প্রদান, মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালার আলোকে খতীব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের ইনসাফ ভিত্তিক সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সরকারের নিকট দাবি, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সকল স্তরে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে, শতকরা ৯২% মুসলিম দেশে সকলে যাতে শূদ্ধভাবে কুরআন শিখতে ও বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারে সেজন্য কুরআন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাস্তরসমূহে কুরআনের হাফেজ/ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানানো হয়, আল্লাহ, আল্লাহর রসূল (সা), কুরআন ও ইসলাম নিয়ে কুটক্তিকারীদের দৃশ্যমান বিচারের আওতায় আনার দাবি, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভিনদেশী আগ্রাসনের হাত থেকে মুক্ত রাখতে এবং সকল আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দলমত, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে সকল নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ থাকার উদাত্ত আহবান, সেই সাথে প্রথিতযশা আলেমেদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় শিক্ষা কমিশন পুনর্গঠন, মসজিদের ইমামদেরকে দেশ ও জাতির কল্যাণে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতায়ন এবং এ সম্মেলন ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকদ্দাসের স্বাধীনতা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকার সকল সামরিক ঘাটি বিলুপ্ত, অসহায় ফিলিস্তিনী শিশু ও নারীদের উপর বিশ্বসন্ত্রাসী ইসরায়েল কর্তৃক বর্বরোচিত গণহত্যা বন্ধে স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বিরতি, যুদ্ধ অপরাধী নেতানিয়াহুকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে দৃশ্যমান বিচার কার্যকর করতে জাতিসংঘের নিকট জোর দাবী জানানো হয়। একই সঙ্গে মাজলুম ফিলিস্তিনীদের আর্তনাদে সাড়া দিয়ে সম্মিলিত মুসলিম সামরিক বাহিনী গঠন করে সন্ত্রাসী ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে জিহাদের আহ্বান জানানোর জন্য ওআইসিকে এই সম্মেলন থেকে উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। 

সম্মেলন শেষে দেশ, জাতি তথা মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও কল্যাণ এবং ইমাম পরিষদের মৃত সদস্যদের রুহের মাগফেরাত ও অসুস্থদের সুস্থতা কামনা করে দোয়া করা হয়। দোয়া পরিচালনা করেন হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী মহাপরিচালক আল্লামা মুফতি জসিম উদদীন।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে