আপনি কি কোনোভাবে বইমেলা বা বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে হোক, এমন সিদ্ধান্তের বিপক্ষে? যদি না হোন, তাহলে নিশ্চিত আপনি দেশ-মানুষ-সমাজ-সুশিক্ষা এবং সভ্যতার পক্ষের মানুষ। একজন লেখক, পাঠক বা সচেতন নাগরিক হিসেবে বরাবরই আমি বইমেলার পক্ষে। বইয়ের পক্ষে। লেখালেখির পক্ষে। আর তাই যখন শুনি- ‘আমাদের দেশে যত বই বের হয়, পাঠক তত নেই।’ তখন মনে হয়, একথা যারা বলেন, তারাই মূলত নিজেরাই নিজেদের অজান্তে পাঠক ও লেখকবিরোধী হয়ে উঠছেন। তবে একথা সত্য যে, পাঠকের চেয়ে কয়েকজন লেখকের ভক্ত তৈরি হয়। লেখকের উপস্থিতিতে পাঠক বই কিনতে চায়। হয়ত অটোগ্রাফের আশায়। সব লেখকের নির্দিষ্ট কয়েকজন পাঠক তো থাকেই, সেই সঙ্গে বইমেলায় তৈরি হয় নতুন নতুন পাঠক। সেই বইমেলা আটকে আছে ছাত্র বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকারের সিদ্ধাহীনতায়। এমন পরিস্থিতিতে তরুণ লেখকদের একটি অংশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে অনানুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানালেও কোনো গতি হয়নি ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা করার বিষয়টির। তবে বরাবরের মতো অবিরত আমি মনে করি, ‘মহান একুশে বইমেলা’ কে কোনো টানা হেঁচড়া না করে ফেব্রুয়ারিতেই রাখা হবে বুদ্ধিদ্বীপ্ততার উদাহরণ। সেই উদাহরণ দিতে ব্যর্থ হলে ‘টেলিভিশন’ সিনেমার মাধ্যমে যে ধর্ম-মানবতা-শিক্ষা-সমাজ-সভ্যতার পক্ষের পরিচয় সংস্কৃতি উপদেষ্টা ফারুকী দিয়েছিলেন, তা নিয়ে টানাপোড়েন নির্মিত হবে বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি সচেতন নাগরিকদের মাঝে।
ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা হওয়ায় সেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী চিত্তরঞ্জন সাহাসহ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের স্মৃতিবিজড়িত বইমেলা চলাকালে পড়ে পহেলা ফাল্গুন ও ভ্যালেন্টাইন্স ডে। অন্যদিন বই নেড়েচেড়ে দেখলেও সেদিন প্রায় সবাই তার প্রিয় মানুষকে পছন্দের বইটিই কিনে দেয়। এতে ভালোবাসার সঙ্গে যুক্ত হয় চমৎকার একটি অভ্যাস। তা হলো, বই কেনা ও উপহার দেওয়া। অনেকের মতো আমারও এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে লিখতে গেলে বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। কারণ এই বইমেলায় আমরা হারিয়েছি আমাদের অনেকেরই সোনালি অতীত। সেখানে বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, সমুদ্র গুপ্ত, আবদুল মান্নান সৈয়দ, প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদসহ শত শত স্বপ্নজ মানুষ থাকতেন। ভালোবাসতেন কেবল বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতে। বারো মাসই চলত তার লেখালেখি আর পড়াশোনা। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের লেখালেখি-কর্মব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। লিখতেন একের পর এক বই। প্রুফ রিডিং হয়ে আসার পর আবার সেটা চেক করতেন। প্রচ্ছদের বিষয়ে খুব বেশি খুঁতখুঁতে ছিলেন অনেকেই। প্রচ্ছদশিল্পীর সঙ্গে প্রচ্ছদ নিয়ে বারবার আলোচনা করে একটা ফাইনাল প্রচ্ছদ দাঁড় করাতেন প্রিয় এই মানুষেরা।
আমি সেই বরেণ্যদের অনেকেরই স্নেহাচার্য পাওয়ার সুযোগ পেয়েছি এই বইমেলাকে কেন্দ্র করেই। তাও আবার শীতঘেষা বইমেলা- ফেব্রুয়ারির মহান একুশে বইমেলা। ‘বইমেলা’ কিংবা ‘গ্রন্থমেলা’ শব্দ দু’টির যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এই মেলার কথা শুনলেই আমাদের চোখের পাতায় ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমির বইমেলা। যে মেলা বইপ্রেমী মানুষের প্রাণে দোলা দেয়। কোনো এক অদৃশ্য শক্তিবলে লাখো মানুষকে টেনে আনে একাডেমির বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে। বর্ধমান হাউস, একাডেমি প্রাঙ্গণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে জমে ওঠা লেখক-পাঠকের অঘোষিত সম্মিলন ফেরাতে, জমজমাট আড্ডা ফেরাতে কেউ এগিয়ে না আসলেও আমরা আসবো, আমরা বলবো ‘বইমেলা’র ফেব্রুয়ারিতে বাস্তবায়নের পক্ষে কথা। অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের কাছে ব্যাপকভাবে একুশে বইমেলা নামেই পরিচিত হলেও এর ইতিহাস সেই ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে শুরু। বই প্রেমি, লেখক প্রেমি, পাঠক প্রেমি চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার শুরু করেন। এই ৩২টি বই ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি মহান একুশে মেলা উপলক্ষ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং এদের দেখাদেখি আরও কেউ কেউ বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এরপরের বছরের কথা, ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে।
এ উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রফেসর আবু মহাম্মেদ হবীবুল্লাহ। ঐ গণজমায়েতকে সামনে রেখে ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একাডেমির পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় যে যার মতো কিছু স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এতে বাংলা একাডেমির কোনো ভূমিকা ছিলো না শুধু মাঠের জায়গাটুকু দেওয়া ছাড়া। সেই ইতিহাসের আলোয় দেখা যায়- ১৯৭৫ সালে একাডেমি মাঠের কিছু জায়গা চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। প্রকাশকরা যে যার মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। সেই যে জাতির সামনে নিমগ্ন চেষ্টায় জ্ঞানের ফেরীওয়ালাদের পথচলা শুরু হলো; গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা যথাযথভাবে চললেও মাত্র ১ বছরের মাথায় এমন সিদ্ধান্ত আমাকেই কেবল ব্যথিত করেনি, আমি বিস্বাস করি সকল সচেতন নাগরিককে ব্যথিত করেছে। সকল ব্যথার উপশম ঘটাতে নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যেই বইমেলা বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি। আমি মনে করি সেই বইমেলায় আরো দৃঢ় উদ্যোগে গড়া হবে বইবন্ধন। কেননা, একুশে বইমেলা নিছক কোনো বইমেলা নয়; একুশে বইমেলা আমাদের এগিয়ে চলার স্মারক। কোনোভাবেই এই বইমেলাকে যেন ফেব্রুয়ারি থেকে সরিয়ে অন্য কোনো মাসে স্থানান্তর করা না হয়। বইমেলাকে বন্ধ রাখার পক্ষে অনেকেই সাফাই গেয়ে ইতোমধ্যে অবশ্য বলেছেন, নির্বাচনই শুধু অন্তরায় নয় এই বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে করার জন্য; ফেব্রুয়ারিতে আরো অনেক ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় যুক্ত আছে। আমি মনে করি ধর্মীয় বিষয় আশয় বা নির্বাচন কোনো প্রভাবই ফেলবে না ফেব্রুয়ারির বইমেলায়। মহান একুশে বইমেলাকে ফেব্রুয়ারিতেই রাখা হোক নির্বাচন বা অন্য যে কোনো বিষয়কে রাখা হোক সবার আগে। অবশ্য সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এ কারণে ২০২৬ সালের একুশে বইমেলা চলতি বছরের ১৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে বলে ঘোষণা দেয় বাংলা একাডেমি। ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলা একাডেমি ‘অমর একুশে বইমেলা-২০২৬’ এর তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। জানানো হয়েছিল- জাতীয় নির্বাচন ও রোজার কারণে বইমেলা এগিয়ে আনা হয়েছে। আমি মনে করি ফেব্রুয়ারি মাসের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। সৃজনশীল প্রকাশকদের একটি বড় অংশ সময় স্বল্পতার কারণে ডিসেম্বরে মেলা শুরু করা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। লেখকরা আপত্তি জানান। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরাও ডিসেম্বরে বইমেলা অনুষ্ঠানের বিষয়ে বিরোধিতা করেন। তাতেও যেন কিছুই যায় আসে না কারো বরং গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে বাংলা একাডেমি জানিয়েছে- ‘অমর একুশে বইমেলা আসন্ন জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আয়োজনের ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি (বাপুস) ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের মতামতের ভিত্তিতে ‘বইমেলা ২০২৬’-এর যে তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা স্থগিত করা হলো।’ বাংলা একাডেমির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০২৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের সিদ্ধান্ত এটি।’
২১ সেপ্টেম্বর অতিক্রম করে অক্টোবরের শেষ সময়ে আমরা এখন, অথচ কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বইমেলা নিয়ে। মহান একুশে বইমেলা মানে আমাদের প্রাণের সম্মিলন; এই সম্মিলনকে বন্ধ করে দিতে শুরু হয়েছে নানামুখী ষড়যন্ত্র। সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিতে তারুণ্যের প্রকৃত শক্তির ঐক্যবদ্ধতা আজ জাতির খুব বেশি প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনের কথা ভেবে বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম-মানবতার পক্ষের মানুষদের ঐক্যবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। চলুন নিরন্তর বইমেলা আর ফেব্রুয়ারির মহান একুশে বইমেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সাথে নিয়ে। সেই সাথে যদি সম্ভব হয়, ‘আন্তর্জাতিক একুশে বইমেলা ২০২৬’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। যেই বইমেলায় শুধু বাংলাদেশ নয়; অংশ নিবে বিশ্বের ১৯৮ টি দেশের লেখক-প্রকাশকগণ। এমন স্বপ্ন দেখছি আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নয়; জেগে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে বলছি- আপনিও এই স্বপ্ন দেখুন একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে, বাংলাদেশের মতো একটা থেকেও এগিয়ে চলা লেখক হিসেবে, নোবেলজয়ী হিসেবে...
লেখক: মোমিন মেহেদী