রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযুক্তদের সাথেও আপোষ করতে পারে, কিন্তু শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত অনৈতিকদের সঙ্গে একটুও আপোষ করা যাবে না। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের প্রতি যাদের ভিত্তিহীন সহানুভূতি থাকবে, তাদেরকেও রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। যারা জাতির নির্মাতা, মানুষ গড়ার কারিগর, তারা জাল-জালিয়াতি করে শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশার সঙ্গে যুক্ত হলে প্রাতিষ্ঠানিক পবিত্রতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। মেধা ও যোগ্যতায় যারা চাকরি পায়, তারা আরও ভালো কোনো সুযোগ পেলে চাকরি বদলে যেতে পারে; কিন্তু যারা অবৈধভাবে চাকরি পায়, তাদের সারাজীবন একই চাকরিতেই কাটে।
কাজেই জালিয়াতির মাধ্যমে যে লোক একবার শিক্ষক পরিচয় পান, তিনি সারাজীবনের জন্যই শিক্ষক হয়ে থাকেন। একটা প্রতিষ্ঠানে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশার সঙ্গে একজন অসৎ ব্যক্তির জড়িত থাকা মানে কত হাজার হাজার শিক্ষার্থীর নৈতিকতা ধ্বংস করে দেওয়া - তা কি ভাবতে পারছেন? একজন অসৎ মানুষ কখনোই সততার গল্প বলে কাউকে প্রভাবিত করতে পারে না। যে পেশার সঙ্গে মানুষ গড়ার দায় যুক্ত, সেই পেশায় ভণ্ডদের সংযুক্তি মানে জাতীয়তায় ভণ্ডামির উৎপত্তির সুযোগ সৃষ্টি। রাষ্ট্র যেন এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত না নেয়-জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষক হওয়াদের কোনো ক্ষমা নেই।
সিস্টেমের ভেতর থেকে কেউ যদি সহায়তা না করে, তবে কারও বাপেরও শক্তি নেই জাল সনদে শিক্ষক হওয়ার! পুলিশ ভেরিফিকেশন, ইনডেক্সপূর্ব যাচাই- সবার চোখ ফাঁকি দেওয়া আসলে সহজ? দেশব্যাপী ভুয়া সনদে চাকরি পাওয়া কথিত শিক্ষকদেরকে যারা জাল সনদ তৈরি করে দিয়েছে, সুপারিশে সহায়তা করেছে-তাদের চক্রকে চিহ্নিত করা জরুরি। যে সিন্ডিকেটের সহায়তায় অসাধুগণ জাল সনদ জোগাড় করতে পেরেছে, তাদেরকে প্রকাশ্যে আনতে না পারলে এই মহামারি থেকে জাতি কখনোই মুক্তি পাবে না। জাল সনদ তৈরির দুর্নাম একসময় নীলক্ষেত বহন করতো কিন্তু এখন তা বোধহয় ঠিকানা বদল করেছে! কোথাও কোথাও সর্ষের ভেতরেই ভূত! জাল সনদধারীদের জেরা করলে জালিয়াতির মহাসত্য উদ্ঘাটিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
যেহেতু নিয়োগের সুপারিশ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই হয়, সেহেতু বাহির থেকে জাল সনদ তৈরি করে সেটা ভেতরে পাঠানো-এমন যুক্তি ধোপে টেকে না। তবে জালিয়াতি ধরা পড়ে কীভাবে? যে চক্র জালিয়াতি করে এবং যারা জালিয়াতির বিরুদ্ধে তদন্ত করে-তারা পরস্পর বিরোধী মতাদর্শের বলেই এই গোমর ফাঁস হয়। ধারণা করি, প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের কিছু অসাধু ব্যক্তির সঙ্গে সারা দেশব্যাপী জালিয়াত চক্রের একটা সুহৃদ সম্পর্ক আছে। অর্থের বিনিময়ে এই অপরাধ তারা অনায়াসেই করে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এনটিআরসিএর কাছে ইতোমধ্যে ৬০ হাজার জাল শিক্ষকের তথ্য আছে। জাল-জালিয়াতির এই চেইনে আরও কতসংখ্যক শিক্ষক জড়িত তা আল্লাহই জানেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা ধ্বংস ও পরিবেশ নষ্টে এই জালিয়াতরাই নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে। গ্রুপিং করা, তেজ দেখানো কিংবা ভাব ধরা-এহেন অপকর্ম নেই যা তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে না করে। এদেরকে শিক্ষকসুলভ মানসিকতার তুলনায় বেশি রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধির ভূমিকায় দেখতে পাওয়া যায়। এনটিআরসিএ বলছে, তাদের কাছে প্রতিদিন গড়ে দশটির বেশি অভিযোগ আসে জাল সনদ বিষয়ক শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সনদ তদন্তে। ভাবতে পারছেন, সারাদেশে চিত্র কতটা বিপজ্জনক?
শ্রেণিকক্ষের পাঠদানে এদের যে অস্বস্তি সৃষ্টি করে, তা নিরূপণ করা কঠিন। অথচ নীতিকথা বলার সময় এই ভণ্ডদের কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারে না। শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা, ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও কাজে ব্যবহার করা এবং প্রতিষ্ঠানের ভিতরে বা অভিভাবকদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি-এসবের নেতৃত্ব তো এরাই দেয়। এই জালিয়াতদের কারণেই শিক্ষকতা তার আদি মর্যাদা হারিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত ধরনের অশিক্ষা ও অপশিক্ষামূলক কার্যক্রম আছে, তাতে এদের উপস্থিতি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। নকলকে প্রশ্রয় এবং প্রশ্নফাঁস চক্রে এরাই জড়িত। রাষ্ট্র যদি এদের উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়, তাহলে রাষ্ট্র পুরোপুরি ডুবে যাবে।
জাল সনদে শিক্ষক হওয়া এবং চাকরি প্রাপ্তদের দ্রুত চিহ্নিত ও অপসারণের জন্য একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অযোগ্যরাই সকল অযৌক্তিক দাবীদাওয়া আদায়ের আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকে এবং রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাদের কঠোর হস্তে দমন ও গুরুদণ্ড দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শিক্ষায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি। অনেককিছুর সঙ্গে আপোষ করা গেলেও মানসম্মত শিক্ষা রক্ষায় আপোষহীন থাকতে হবে। সরকারকেই রাষ্ট্রটাকে বাঁচাতে হবে। জাল সনদের শিক্ষকদের প্রতি যদি রাষ্ট্রের দয়া করতে ইচ্ছে করে, তবে তাদের অন্য ধরনের কাজে প্রয়োগ করা যেতে পারে-তবুও তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার্থীদের সাহচর্যে রাখা যাবে না। জাল সনদে শিক্ষকতা করার সুযোগ দেওয়া-এই ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কোনো বিবেকবান জাতি গ্রহণ করতে পারে না।
ভুয়া ও ভণ্ড, অবৈধ পথে সম্পদ অর্জনকারী, অনৈতিক সুযোগ নিয়ে সনদধারী আধিপত্য স্থাপনকামী-এরা এক সাধারণ সূত্রে আবদ্ধ। এদের প্রশ্রয় দিতে দিতে রাষ্ট্র একসময় বিপদে পড়বে। কাজেই অন্যায়কে মুকুলে প্রতিহত করতে হয়। যদিও জাল সনদে বিস্তৃত কথিত শিক্ষকদের অপরাধ এখন আর শুধুমাত্র মুকুল পর্যায়ে নেই-বরং কাণ্ড-মূল পর্যন্ত বিস্তৃত-তবুও রাষ্ট্রের সর্বশক্তি নিয়োগ করে এদের ঠেকাতে হবে, বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে। তাদের প্রকাশ্যে চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে ধিক্কার জানানো প্রয়োজন।
অপরাধকে যদি লজ্জা হিসেবে উপস্থাপন করতে সাধুগণ ব্যর্থ হয়, তবে অপরাধের বিস্তৃতি বাড়বে। স্বভাবগতভাবেই মানুষ নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। কাজেই রাষ্ট্র কঠোর হোক। শিক্ষাগৃহ থেকে অশিক্ষকদের ঝেঁটিয়ে বিতাড়িত করার এটাই উপযুক্ত সময়। আমাদের বোধোদয় হোক। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করায় কেউ শারীরিক ব্যয়ও ভোগ করেছেন-রাষ্ট্র কেন অন্যায়ের কাছে নমনীয় হয়? অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়াও অন্যায়।
কল্পনা করছি, জাল সনদে শিক্ষকতার অপরাধে চাকুরি হারানোরা চাকুরি ফিরে পেতে শাহবাগে জড়ো হয়েছে, শহীদ মিনারে অনশন করছে এবং যমুনা অভিমুখে যাত্রার ঘোষণা দিয়েছে। পুলিশ এসে এদেরকে প্রতিহত করার আগেই জেন-জি এসে এদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দৃশ্যটা কেমন হবে? আমি ব্যক্তিগতভাবে সকল মবের বিরুদ্ধে। শৃঙ্খলায়িতভাবেই বিশৃঙ্খলা দূর হোক। আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন আরেকটু দ্রুতগামী হোক। অপরাধ শেকড় দেওয়ার সুযোগ পেলে তার অনেক ডালপালা ছড়িয়ে যায়।
লেখক: রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক