সব খাতে সরকারের খরচ বাড়লেও আয় বাড়েনি

এফএনএস এক্সক্লুসিভ | প্রকাশ: ৭ নভেম্বর, ২০২৫, ০৮:২৫ এএম
সব খাতে সরকারের খরচ বাড়লেও আয় বাড়েনি

সব খাতে সরকারের খরচ বাড়লেও আয় বাড়েনি। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তীব্র আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। মূলত রাজস্ব আদায় হ্রাস, বিগত সরকারের নেয়া ঋণ পরিশোধ বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আর্থিক সংকট মোকাবিলা করা এবং সরকারের পরিকল্পিত চলতি ব্যয় মেটাতে নির্ভর করতে হচ্ছে ঋণের ওপর। যদিও আর্থিক দুরবস্থার কারণে সরকার কৃচ্ছ সাধনের নীতি গ্রহণ করেছে। উন্নয়ন প্রকল্পে একেবারেই কম ব্যয়। তারপরও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে। পাশাপাশি কমে যাচ্ছে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ। আর সরকারি খাতের ঋণ বাড়ায় সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ সামান্য বেড়েছে। তবে সরকারি খাতের ঋণ কমাতে এবং বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে দাতা সংস্থা আইএমএফ চাপ দিচ্ছে। সংস্থাটি বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ অব্যাহতভাবে নিম্নমুখিতাকে উদ্বেগজনক হিসাবে চিহ্নিত করেছে। আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারি খাতে চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ঋণপ্রবাহ ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে। তবে বাড়েনি বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। বরং দশমিক ০৩ শতাংশ কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট দুই মাসেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নেতিবাচক। বেসরকারি খাতে আমদানি বাড়লেও রপ্তানি খাত, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে না। কয়েক বছর ধরেই এ খাতে মন্দা যাচ্ছে। গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হলে এ খাতে মন্দা আরো প্রকট হয় এবং এখনো সেই মন্দার প্রভাব কাটছে না।

সূত্র জানায়, সরকারি খাতে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের মাত্র ২৮ শতাংশ যাচ্ছে। বাকি ৭২ শতাংশই বেসরকারি খাতে যাচ্ছে। তার মধ্যে গ্যাস, জ্বালানি তেল আমদানির ঋণ সরকারি খাতে গেলেও তার বড় অংশই বেসরকারি খাত ভোগ করে। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণের অংশ আরো বেশি হবে। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি ২৩ লাখ কোটি টাকার মধ্যে বেসরকারি খাতে রয়েছে সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা আর সরকারি খাতে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমলেও কেবল সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ার কারণে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। তবে ঋণপ্রবাহ সরকারি খাতে বাড়ার কারণে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে তার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। সরকার মূলত পরিকল্পিত চলতি ব্যয় নির্বাহ করতেই নিয়েছে এসব ঋণ। হঠাৎ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে সরকারের অপরিকল্পিত ব্যয় বেড়ে যাবে। তখন ঋণ আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। আর বিগত সরকার সময়ে ব্যাপকভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয়া হয়। ওসব ঋণ বিগত সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে ডলার ও টাকার সংকটে পরিশোধ করতে পারেনি। ফলে ঋণের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। তাতে ঋণের বিপরীতে সুদ ও দণ্ড সুদ বেড়ে ঋণ পরিশোধের স্থিতিও বেড়েছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে ওসব ঋণ এখন বর্তমান সরকার পরিশোধ করছে। বিগত সরকারের ঋণ পরিশোধের বোঝা এবং রাজস্ব আদায় একেবারেই তলানি নামায় প্রকট আকার ধারণ করেছে সরকারের অর্থ সংকট। সরকার এখন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কম সুদের ঋণের টাকায় ব্যয় নির্বাহ করছে। 

সূত্র আরো জানায়, মাঝে মধ্যে সংকট প্রকট আকার ধারণ করলে সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ছাপানো টাকায় ঋণ নিতে হয়। তবে ছাপানো টাকার ঋণ সাময়িকভাবে নিলেও তা স্বল্প সময়ের মধ্যেই পরিশোধ করে দিচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট  দুই মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় নেয়া ৩ হাজার ১০৫ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে। তবে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে না সরকার। বরং ওই খাত থেকে আগের নেয়া ঋণের মধ্যে ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। তার বিপরীতে নন-ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে। ওই খাত থেকে গত জুলাই-আগস্টে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। ওসব ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছে। তবে নন-ব্যাংক খাতের ঋণের সুদহার বেশি। ওই খাতের সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। তাতে সুদের হার ১১ থেকে পৌনে ১২ শতাংশ। আর ব্যাংক থেকে ঋণের সুদহার ৫ থেকে ১০ শতাংশ।

 তাছাড়া বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে গিয়ে চড়া দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি ঋণের কিস্তি স্থগিত করার কারণে সুদও বেশি দিতে হচ্ছে। ফলে ঋণের বিপরীতে সরকারকে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। তাছাড়া মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ওপরে রয়েছে। প্রায় তিন বছর মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ শতাংশের বেশি থেকে ১১ শতাংশের ওপরে। দীর্ঘ সময় মূল্যস্ফীতির হার বেশি থাকার কারণে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছে। পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের আয় কমায় তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়াতে হয়েছে। এতেও সরকারের খরচ বেড়েছে।

এদিকে রাজস্ব আদায় হচ্ছে সরকারের আয়ের প্রধান খাত। কিনতু দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক মন্দা ও সামপ্রতিক সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সংস্কার কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আয় বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আয় বেড়েছে ২১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় বাড়েনি, বরং কমেছিল আড়াই শতাংশের বেশি। জুলাই-আগস্টে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬১ হাজার কোটি ২৬ লাখ টাকা। তার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৫৪ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। ঘাটতি হয়েছে ৬ হাজার ৫৭৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি হয়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৪৫ হাজার ৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর গত আগস্টের শেষে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমানত বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। যা ব্যাংক খাতে তারল্যের জোগান বাড়ানোর জন্য যথেস্ট নয়। তার মধ্যে মেয়াদি আমানতের হিসাব বাড়ার কারণেই সার্বিকভাবে আমানত বেড়েছে। মেয়াদি আমানত বাড়ার ফলে ব্যাংক খাত দীর্ঘ মেয়াদে আমানত সংকট ঘোচানোর দিকে এগোচ্ছে। তবে চলতি আমানত কম হওয়ার মানে হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কম। যদিও ব্যাংক খাতে আমানত বাড়ায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ বেড়েছে, ডলারের প্রবাহ বাড়ায় বৈদেশিক সম্পদ বেড়েছে। ওই দুটি মিলে দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে। ফলে টাকার প্রবাহ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।