ফ্যাসিষ্ট আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতেই ভারতের মাটিতে খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যা ছিল ২০২৪ সালে দেশব্যাপী আলোচিত ঘটনা। শুধু দেশব্যাপীই নয়, বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলের একজন এমপি হত্যা সে সময় নজীরবিহীন বলে আলোচনায় উঠে আসে। বাংলাদেশী গণমাধ্যম ছাড়াও বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়ায় আনার হত্যার নৃশংসতা ও হত্যার নেপথ্যে কারণ তুলে ধরা হয়। পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল গুলোতে সংসদের একজন আইন প্রনেতা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের শীর্ষ স্বর্ণ চোরাকারবারী ও মাফিয়া ডন হয়ে উঠার খবর প্রচার হতে থাকে। এ ঘটনায় মনোয়ন বাছাইয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের ডুবন্ত ভাবমূর্তি আরো তলানীতে ঠেকে। গত ১১ জুন এমপি আনার হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হলে আনার হত্যার সঙ্গে দলীয় কোন্দল ও মিন্টুর এমপি হওয়ার খায়েশ নতুন করে দেশবাসির সামনে আসে। আনার হত্যার পর সাইদুল করিম মিন্টু কালীগঞ্জ শহরে আনারের বাড়িতে গিয়ে শোকাহত স্ত্রী-কন্যাকে শান্তনা দেন। মিন্টু গ্রেফতারের পর আনার এমপির মেয়ে মমতারিন ফেরদৌস ডরিণ তার পরিবারের সঙ্গে মিন্টুর দেখা করার ঘটনাকে “মাছের মায়ের পুত্র শোক” বলে অভিহিত করেন। আনার হত্যার পর ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগ বহুধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। ঝিনাইদহ শহরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সাইদুল করিম মিন্টুর মুক্তির দাবীতে দলীয় নেতাকর্মীদের মিছিল সমাবেশ চলতে থাকে। অন্যদিকে এমপি আনারের নিজ শহর কালীগঞ্জে আনার হত্যার প্রতিবাদে তার সমর্থকরা সভা সমাবেশ,মানববন্ধন চালাতে থাকেন। গেল বছর ২০২৪ সালের ৬ জুন কলকাতায় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুনের ঘটনায় গ্রেফতার চরমপন্থি ক্যাডার শিমুল ভূঁইয়ার নিকটাত্মীয় কাজী কামাল আহম্মেদ বাবু ওরফে ‘গ্যাস বাবু’ আটক হয়। বাবুর স্বীকারোক্তি মোতাবেক গ্রেফতার হন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী এই দুই নেতা গ্রেফতারের পর আনার হত্যার মোটিভ ও ক্লু উদ্ধারে নতুন করে মাঠে নামে ঢাকা মহানগর গোয়ন্দা পুলিশ। জেলা আওয়ামীলীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক গ্যাস বাবুকে নিয়ে মোবাইল উদ্ধারে ঝিনাইদহে আনা হয়। গত ২৬ জুন হেলিকপ্টারে ঝিনাইদহ শহরে উড়ে আসেন ডিবি প্রধান হারুন। ঝিনাইদহ শহরে দুইটি পুকুরে ডুবরি দিয়ে নিষ্ফল অভিযান চালানো হলেও ওই দিন (২৬ জুন) বিকেলে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডু থেকে আনার হত্যার সন্দেহ ভাজন আসামি মোস্তাফিজুর ও ফয়সালকে গ্রেফতার করা হয়। সংসদ সদস্য খুন হওয়ার আগে গত ২ মে কলকাতায় যান তারা। তারা দেশে ফিরে আসেন ১৯ মে। এই দুজনের বাড়ি খুলনার ফুলতলায়। খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী হিসেবে চিহ্নিত শিমুল ভূঁইয়ার বাড়ি একই এলাকায়। এই দুই আসামির কাছে এমপি আনার হত্যাকান্ডের অনেক তথ্য-উপাত্ত থাকার দাবী করা হলে দেশব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে আনার হত্যার তদন্ত ভাটা পড়ে। সর্বশেষ এমপি আনার কন্যা ডরিণের সঙ্গে ডিএনএ টেষ্ট মিলে যাওয়ার খবর প্রচারিত হয়। ফলে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে প্রমানিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উদ্ধার করা মাংস ও হাড়ের সঙ্গে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের ডিএনএ মিলে যায় প্রায় ৭ মাস পর। আনার পরিবার মনে করেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকান্ডে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ভূমিকা থাকতে পারে। ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার পর ঝিনাইদহে স্বর্ণ চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া শুরু করেছিলেন আনার। এ নিয়ে যশোর ও খুলনার প্রভাবশালী পরিবার নাখোশ ছিলেন আনারের উপর। শোনা যায় খুলনার ঐ পরিবারের কাছে আনার চোরাচালানের রুট ফি হিসেবে কয়েক’শ কোটি টাকা দাবী করেন। চোরাচালানের টাকা নিয়ে মতবিরোধ থেকে প্রতিপক্ষের এমপি হওয়ার খায়েশ নিয়ে রাজনৈতিক দ্বন্দ। ১২ মে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে ভারতে যান এমপি আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মন্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। পরদিন চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকেই রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হন আনোয়ারুল আজীম আনার। বাড়ি থেকে বেরোনোর পাঁচদিন পর ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনোয়ারুল আজীম নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপরও খোঁজ মেলেনি ৪ বারের এই সংসদ সদস্যের। ২২ মে হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক ভবনের বিইউ ৫৬ নম্বর রুমে আনোয়ারুল আজীম আনার খুন হয়েছেন। ঘরের ভেতর পাওয়া যায় রক্তের ছাপ। তবে ঘরে মেলেনি তার মরদেহ। এনডিটিভির খবরে বলা হয়, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্লাটে এমপি আনারকে টুকরো টুকরো করে খুন করা হয়। কলকাতা পুলিশ অভিযান চালিয়ে সঞ্জীবা গার্ডেনসের সেপটিক ট্যাংক থেকে প্রায় ৪ কেজি মাংস উদ্ধার করে। বলা হয় সঞ্জীবা গার্ডেনসের ফ্লাটে এমপি আনারের মরদেহ টুকরো টুকরো করে টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দেয়। এছাড়া শরীরের হাড় কলকাতার ভাঙ্গরের বাগজোলা খালের বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয় তারা। কলকাতা পুলিশ ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা দেওয়ার জন্য আনারের স্ত্রী ইয়াসমিন ফেরদৌস ও ভাই এনামুল হককে ডাকলেও কেবল তার মেয়েই গত নভেম্বরে কলকাতায় গিয়েছিলেন। গত ২২ মে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে একটি মামলাটি দায়ের করেন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। সেই মামলায় ঝিনাইদহ জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু ও জেলা ত্রান ও সমাজ কল্যান সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মেদ বাবুসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে হত্যার নির্দেশদাতা ও মামলার প্রধান আসামি আক্তারুজ্জামান পলাতক রয়েছেন। কলকাতা পুলিশ এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় দু’জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে। এদিকে শেরেবাংলানগর থানায় আনার অপহরণের পর খুনের মামলাটি এখন হত্যা মামলায় রুপান্তরিত হবে কিনা সে প্রশ্ন উঠে আসছে জোরেসোরে।
আনোয়ারুল আজিম আনারের পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা ৩ বার আওয়াামীলীগ থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন আনার। অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবে পুলিশের খাতায় নাম ছিল তার। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে র্দুর্ধষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পান। আনারের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদক দ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি,হত্যা, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ২২ টির বেশি মামলা ছিল। ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার তাকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশনের সময় আত্মগোপনে ছিলেন আনার। সে সময় তিনি ভারতের রানাঘাট এলাকায় পালিয়ে ছিলেন। ১৯৮৬ সালের দিকে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে আনার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্ত পথে চোরাচালান করতেন তিনি। ওই সময় কালীগঞ্জ, মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, চুয়াডাঙ্গা, জীবননগর,দর্শনা থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ স্লিপের মাধ্যমে মাদক ও ভিসিপি চোরাচালান করতেন ভারতে। ওই টোকেন দেখালেই পুলিশের লোকজন বহনকারী গাড়ি ছেড়ে দিত। এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক সম্রাট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এখনো তার নিয়োজিত প্রতিনিধিরাই কালীগঞ্জ শহরে ফেনসিডিল ব্যবসা করে যাচ্ছেন। এই মাদক কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান আনার। ১৯৯১ সালে আনার ঝিনাইদহের আরেক চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুরের সঙ্গে মিলে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্বর্ণের বড় বড় চালান রাজধানী থেকে বাঘাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করতেন। ১৯৯৬ সালে আনার বিএনপি থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগে যোগ দেন। সরকারের পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ দাস ভারতে আত্মগোপন করার পর তার মাধ্যমে অস্ত্র চোরাকারবার চালিয়ে যেতেন আনার। বাগদা এলাকার মাদক সম্রাট জয়ন্ত কুমার, কার্তিক, গৌতম সাহা ও বনগাঁর দেবদাসের সঙ্গে আনারের মাদকের কারবার ছিল। ২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর এলাকা থেকে ১২ কেজি ৯৫০ গ্রাম স্বর্ণ আটক করে তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। চোরাকারবারিরা নিশ্চিত হয় যে, দর্শনা শ্যামপুরের সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম স্বর্ণগুলো ধরিয়ে দিয়েছেন। ওই ঘটনায় টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন শ্যামপুর গ্রামের সাইফুল। তিনি নিজেও স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন। ওই হত্যা মামলায় আনারসহ আসামি করা হয় ২৫ জনকে। কুষ্টিয়ার চরমপন্থি নেতা মুকুল, শাহীন রুমী, ঝিনাইদহের চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুর, আনারসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিতোষ ও আনারসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। এ মামলায় আনারকে গ্রেফতারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। ওই বছরের ২১ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতারের জন্য কালীগঞ্জ শহরের বাড়িতে অভিযান চালায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলা গুলো কমতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামীলীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে সব মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন।