অযত্ন অবহেলায় খালিশপুরে স্মৃতি বিজড়িত নীল কুঠিবাড়ি ধংসের প্রান্তে

এফএনএস (টিপু সুলতান,কালীগঞ্জ,ঝিনাইদহ) : | প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর, ২০২৫, ১২:৫৭ পিএম
অযত্ন অবহেলায় খালিশপুরে স্মৃতি বিজড়িত নীল কুঠিবাড়ি ধংসের প্রান্তে

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝিনাইদহের কপোতাক্ষ তীরের খালিশপুরের নীলকুঠি। এ ঐতিহাসিক ভবনটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্যে এদেশে ইংরেজ শাসনের পত্তন হয়। ভাগ্য বদলের জন্য শত শত সাহেব এদেশে আসে।তাদের একটা বড়ো অংশ নীলের ব্যবসায়ে নামে। তত্কালীন যশোর,নদীয়া ও রাজশাহী অঞ্চলে তারা কুঠি স্থাপন করে নীল চাষ শুরু করে।যশোর অঞ্চলে অনেকগুলো নীলকুঠি স্থাপিত হয়েছিল। নীল বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল এ অঞ্চল থেকে।শৈলকুপার বিজুলিয়া নীলকুঠির ডাম্ভেল সাহেব ছিল খুবই অত্যাচারী। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ৫০ গ্রামের চাষিরা দেশি অস্ত্র নিয়ে কুঠি আক্রমণ করেছিল। কুঠিয়াল সাহেব পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিলেন।কৃত্রিম নীল আবিষ্কারের পর নীল ব্যবসায়ে ভাটা দেখা দেয়। সাহেবগণ ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে থাকে। এদেশীয় জমিদাররা কুঠিগুলো কিনে তাদের কাচারি স্থাপন করতে থাকে। খালিশপুর কুঠি নীল চাষের শেষ দিকে স্থাপন করা হয়েছিল। সাহেবদের কাছ থেকে কুঠিটি কিনে নেন পাবনার এক জমিদার। তিনি তার জমিদারির কাচারি স্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জমিদার দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। একজন নায়েব দেখাশুনা করতেন। ১৯৫২ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে নায়েবও এ কুঠি ছেড়ে চলে যান। ১৪ একর জমির ওপর স্থাপিত নীলকুঠি সরকারে খাসে নেওয়া হয়। এরপর থেকে দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। দ্বিতল এ কুঠিটি সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের পথে।

খালিশপুর নীলকুঠি ভবন ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন।ইংরেজ আমলে নির্মিত এ নীলকুঠিটি খালিশপুর নামক গ্রামে অবস্থিত।ইতিহাস থেকে ও স্থানীয় সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,১৮১১ সালে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর দুতিয়ার কাঠি কুঠির মালিক মিঃ ব্রিজেবেন খালিশপুর কপোতাক্ষ নদীর তীরে কুঠিটি স্থাপন করেন। সে সময় খালিশপুর থেকে সাগরদাড়ি হয়ে কলকাতা পর্যন্ত লঞ্চ, স্টিমার চলাচল করত।তৎকালীন কুঠি কাচারী হিসেবে ব্যবহার হতো। কলকাতা থেকে অনেক কুঠিয়াল সাহেব নদী পথে কাচারী বাড়িতে আসতেন। এক সময় বৃহত্তম যশোর জেলায় অনেক ইংরেজ নীল ব্যবসায়ির আগমন ঘটে।কারণ বৃহত্তম যশোর-ঝিনাইদহ জেলার মাটি নীল চাষের জন্য উপযোগী ছিল।

এই অঞ্চলের এনায়েতপুর,নগরবাথান,মধুপুর,ঝিনাইদহ,হাজরাতলা,কলোমনখালী, কালীগঞ্জ, শৈলকুপার বুজিলিয়া,হরিণাকুন্ড,জোড়াদাহ,দুনিয়া কোটচাঁদপুরের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজরা নীল চাষ শুরু করে। এ এলাকার সাওতাল সম্প্রদায়সহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন ছিল নীল চাষের শ্রমিক।সেই সময় ইংরেজরা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠি স্থাপন করে। একাধিক নীল কুঠি নিয়ন্ত্রিত হতো কনসার্ন অফিস দ্বারা। সে সময় কাঠগড়াকনসার্ন অফিসের অধীন ছিল খালিশপুর নীলকুঠি।নীল চাষে ইংরেজ নীলকর সাহেবদের মধ্যে মধুপুরের নীল কুঠির কুঠিয়াল টিসিটুইডি,কোটচাঁদপুরের নীল কুঠিয়াল সিনোলব ম্যাকলিউড,ডাম্বল, ব্রিজবেন,নিউ হাউস সাহেব উলেখযোগ্য।নীলকর সাহেবরা মাঠে নীল চাষ দেখতে বেশিরভাগ সময় ঘোড়ায় চড়ে ঐলাকায় যাতায়াত করতেন। কষ্টকর ও নির্যাতনমূলক নীল চাষ করতে এলাকার কৃষকরা এক পর্যায়ে অনাগ্রহ প্রদর্শন শুরু করেন।১৮১০ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত এই নীলকুঠিটি নীলচাষের জন্য ব্যবহার করা হতো। ১৮৬০ সালের দিকে এ অঞ্চলে নীল চাষের বিরদ্ধে নির্যাতিত কৃষকরা বিদ্রোহ করেন। লঞ্চযোগে ভ্রমণের সময় হাজার হাজার কৃষক ইংরেজ ছোট লাট গ্রান্ট সাহেবকে কুমার ও কালী নদীতে ঘেরাও করেন এবং নীল চাষ বন্ধের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। সরকার ১৮৬০ সালেই নীল কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই নীলকর সাহেবরা এই নীলের চাষ আবার শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় তৎকালীন নীলকুঠির মালিক জমিদারও জায়গাটি ছেড়ে চলে যান। 

দক্ষিণমুখী কুঠির ভবনের দৈর্ঘ্য ১২০ ফুট, প্রস্থ ৪০ ফুট ও উচ্চতা ৩০ ফুট। দক্ষিণ দিকে প্রশস্ত বারান্দা। এটি ১২ টি কক্ষ বিশিষ্ট দ্বিতল ভবন। দেওয়াল ২০ ইঞ্চি পুরু। নিচের তলা থেকে উপরের তলার কক্ষগুলো আয়তনে বড়। চুন, শুরকি ও পাকা ইটের তৈরি। গোসল করার জন্য পাকা সিড়ি কপোতাক্ষ নদীর তীর পর্যন্ত নামানো। নীলকুটিতে রয়েছে একটি আমবাগান। নীলকুটি ও আমবাগান মিলিয়ে সংলগ্ন এ জায়গাটি ১১.২৪০০ একর জমির উপর অবস্থিত। বর্তমানে নীলকুঠির পাশেই স্থাপিত রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মহাবিদ্যালয় ও বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর।বর্তমানে কুঠিরটি জরাজীর্ণ, সংস্কারের অভাবে কুঠিবাড়িটি ধ্বংসের দাঁর প্রান্তে  অবস্থান করছে। কুঠিবাড়িটি স্থানীয় মানুষের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের সাক্ষ্য দিচ্ছে ফলে এটি এখন ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করছে। এখানে পার্ক তৈরি হলে মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থার সাথে সাথে সরকার অর্থিক ভাবে লাভবান হবে। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা এ অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে