ঢাকার ভিড়ের শেষ প্রান্তে, যেখানে রাস্তার আলো নিঃশব্দে মিশে যায় বিকেলের মলিন আলোতে, এক ছোট্ট কফি শপ দাঁড়িয়ে আছে। জানালার কাচ ভেঙে সূর্যের আলোর কিরণ ভিতরে ঢোকে, যেন অদৃশ্য হাত দিয়ে স্পর্শ করছে ধুলোমাখা টেবিল আর পুরনো কাঠের চেয়ারগুলোকে। মেহেদী প্রতিদিন বিকেলে সেই কফি শপের পাশ দিয়ে হাঁটে। তার হাতে একটি পুরনো ডায়েরি, পাতা ভাঁজ, কিন্তু শব্দগুলো হৃদয়ে নীরব সুরে দোলে।
মেহেদী একজন তরুণ লেখক। তার চোখে শহরের অব্যক্ত ব্যস্ততা, জীবনের অজানা বোঝা। সে ভালোবাসা খুঁজে পায়নি—না, খুঁজেছে, তবে শহরের দ্রুত গতির ধুলোয় হারিয়েছে।
ডায়েরিটি তাকে ফিরিয়ে আনে এক অচেনা আলোয়, এক মুখের দিকে—যা সে কখনো ভুলতে পারেনি। নামটি ছিল—আলিশা।
আলিশা। কলেজের দিনগুলোতে, যখন বইয়ের পাতায় চোখ রাখত, হঠাৎ তার চোখের কোণে ভেসে যেত হাসি। হাসি যা এক মুহূর্তে মেহেদীর সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দিত, যা রাতের নিঃশব্দে স্বপ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াত। তাদের প্রেম সরল ছিল, কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুর গতি তাদের পথ আলাদা করে দিয়েছিল। একদিন হঠাৎ আলিশা চলে গিয়েছিল—বিদেশের এক অজানা শহরে, উচ্চশিক্ষার নামে।
ডায়েরির প্রথম পাতাটি খুলতেই স্মৃতির ঢেউ ভেসে আসে মেহেদীর চোখে।
সেখানে লেখা ছিল—“যে মানুষকে তুমি হারাবে, সে তোমার জীবনের শেষ মিশন হয়ে যাবে।” সেই বাক্য যেন মেহেদীর হৃদয় স্পর্শ করে, নিঃশব্দে বলল, “এখনই সময়। এখনই তাকে খুঁজে বের করার।”
দিন যায়, মাস যায়। মেহেদী একা হাঁটে শহরের ফাঁকা রাস্তায়, ভাঙা লাইটের আলোয় তার ছায়া দীর্ঘ হয়ে যায়। সে জানত—আলিশা হয়তো ভাবছে, সে অন্য জীবনে সুখী। কিন্তু মেহেদীর হৃদয় এখনও তার জন্য বাজছে।
এক বিকেল, পুরনো কফি শপের ধুলো-ঢাকা জানালার পাশে হঠাৎ দেখা হলো আলিশার সঙ্গে। চোখের মিলনেই মুহূর্ত থেমে গেল। আলিশা চুপচাপ বসে, হাত কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। মেহেদীর চোখে ভেসে উঠল অজানা আবেগ।
“মেহেদী… আমি… আমি ভাবিনি তোমাকে আবার দেখব।” আলিশার কণ্ঠ কাঁপছে, চোখে অশ্রু।
“আমি কখনো ভুলিনি।প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত তোমার জন্য লেখা হয়েছে।” মেহেদীর কণ্ঠে বেদনার সুর, যা শহরের নীরবতাকে ছেদ করল।
তারা দীর্ঘ সময় কিছুই বলল না। শুধু চোখের ভাষা, অঙ্গভঙ্গি, আর হৃদয়ের নিঃশ্বাসই তাদের সংলাপ। অতীতের সুখ, হারানো দিন, আর অমলিন ভালোবাসার বেদনাগুলো ঝরে পড়ল নদীর ধারে।
কিন্তু জীবন আবারও পরীক্ষা নিল। আলিশার বিদেশে ফেরার দিন ঠিক হয়ে গেছে। মেহেদী জানল—এবারের বিদায় হয়তো চিরকাল। সে হাত বাড়িয়ে ধরল আলিশার হাত।
“দূরত্ব আমাদের হারাতে পারবে না। ভালোবাসা শুধু অনুভূতি নয়; এটি বেঁচে থাকে স্মৃতি, বেদনা, আর প্রতিজ্ঞায়।”
আলিশার চোখে অশ্রু, মুখে মৃদু হাসি। তাদের বেদনার ভালোবাসা যেন এক অদৃশ্য সেতু—যা সময়, দূরত্ব, এবং পৃথিবীর সমস্ত বিভাজনকে অদৃশ্য করে দেয়।
তাদের দিনগুলো কাটল নীরব ভালোবাসার মধ্যে। প্রতিটি বিকেল, নদীর ধারে বসে, মেহেদী ডায়েরি লিখত। পাতায় ভরা থাকত তাদের ছোট ছোট মুহূর্তের বর্ণনা—এক কাপ চায়ের গরম ভাব, বাতাসে ভেসে আসা পুরনো ফুলের গন্ধ, কিংবা নিঃশব্দে চোখের মুদ্রায় প্রকাশিত প্রেম।
আলিশা সময় পেতো না সবকিছু প্রকাশ করতে। তার হালকা হাসি, কখনো অশ্রুর কণার স্পর্শ, প্রতিটি নিঃশ্বাস মেহেদীর জন্য নতুন গল্প হয়ে উঠত। তাদের ভালোবাসা ছিল নিঃশব্দ, কিন্তু তীব্র, যেন নদীর ধারা—দৃঢ়, অচল, কিন্তু কখনোই থামে না।
একদিন বৃষ্টি এল। শহর ভিজল, আর নদীর পানি উচ্ছল হয়ে উঠল। মেহেদী আর আলিশা ছাদে দাঁড়িয়ে দেখল বৃষ্টির ফোটা কাচের ওপর পড়ে ঝলমল করছে।
মেহেদীর হাত আলিশার হাতে ছুঁয়ে গেল। হঠাৎ এক দীর্ঘক্ষণ নীরবতা। আর তারপর মেহেদীর কণ্ঠে বেজে উঠল—“যদি সবকিছু হারাই, শুধু তোমার প্রেম বাঁচুক।”
আলিশা চোখ বন্ধ করে মৃদু মাথা নিল। সেই মুহূর্তে তাদের নিঃশব্দ ভালোবাসা শহরের সব শব্দকে নীরব করে দিল।
মাস পার হয়ে গেল। আলিশার ফেরার দিন। মেহেদী জানল—এবারের বিদায় চিরন্তন। কিন্তু সে কিছু লুকালো না।
“আমি চাই, তুমি যেখানে থাকো, আমার স্মৃতি তোমার সঙ্গে থাকুক। আমাদের ভালোবাসা শুধু দেখা নয়, অনুভূতি হয়ে বেঁচে থাকবে।”
আলিশার চোখে অশ্রু, কিন্তু সে হাসল।
“আমিও চাই, এই ভালোবাসা আমাদের সময়ের সীমা ছাড়িয়ে বাঁচুক।”
বিদায়ের পর, মেহেদী নদীর তীরে প্রতিদিন বসে থাকে। সে জানে, ভালোবাসা কখনো হারায় না। কখনো কখনো তা নীরব হয়ে যায়, চোখে অশ্রু, হৃৎপিণ্ডে ব্যথার সুরে। কিন্তু সেই নীরব ভালোবাসা, সেই ব্যথার প্রেম, মানুষের জীবনের সবচেয়ে পবিত্র আলো হয়ে থাকে।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। শহর বদলায়, রাস্তা বদলায়, কফি শপও নতুন রূপ নেয়। কিন্তু মেহেদীর হৃদয় একই থাকে। ডায়েরি খুলে প্রতিটি লেখা পড়তে পড়তে সে অনুভব করে—প্রেম শুধু অনুভূতি নয়; এটি স্মৃতি, বেদনা, নীরবতা, এবং প্রতিজ্ঞা।
এক বিকেল, নদীর তীরে হঠাৎ এক অচেনা তরুণী তার দিকে তাকিয়ে বলে—“আপনি কি মেহেদী?”
মেহেদী কণ্ঠে হালকা কেঁপে ওঠা স্বরে উত্তর দেয়—“হ্যাঁ… আমি সে-ই।”
“আমি আলিশা।”
মেহেদীর চোখে অশ্রু, মুখে বিস্ময়ের হাসি।
হারানো ভালোবাসা ফিরে এসেছে, তবে এবার শক্তিশালী, অভিজ্ঞ, এবং চিরন্তন। শহরের ব্যস্ততা, দূরত্ব, এবং সময়—কিছুই তাদের আলাদা করতে পারে না।
সন্ধ্যা নামল, নদীর পানি ধীরে ধীরে শান্ত হলো। মেহেদী আর আলিশা হাত ধরে হাঁটতে লাগল, শহরের আলো তাদের চারপাশে ঝলমল করছে। তারা জানে, এই ভালোবাসা শুধু অনুভূতি নয়; এটি জীবনকে আলোকিত করার এক অদৃশ্য শক্তি, যা ব্যথা, নীরবতা, এবং স্মৃতির মধ্যে অমর হয়ে থাকে।
এভাবেই মেহেদী আর আলিশার নীরব ভালোবাসা শহরের প্রতিটি ধুলো, প্রতিটি বাতাসে বেঁচে থাকে। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি অশ্রু—সব মিলিয়ে হয়ে ওঠে এক চিরন্তন কাব্যিক প্রেমের চিহ্ন।