সাহিত্য গল্প

অভিমানের শহর

মোঃ শামীম মিয়া | প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর, ২০২৫, ০৫:০৯ পিএম
অভিমানের শহর
ঢাকার ব্যস্ত ফার্মগেট মোড়। ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে আছে লাল আলো, মানুষ আর গাড়ির ঢল মিশে তৈরি করেছে এক অদ্ভুত বিশৃঙ্খলার সিম্ফনি। সকালবেলার তাড়াহুড়া, বাসের ভিড়, রিকশার ঘণ্টাধ্বনি, চা দোকানের ধোঁয়া—সব মিলিয়ে যেন শহরটা একটা জীবন্ত কোলাহল। এই ভিড়ের মাঝেই প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে রিয়াদ। বয়স তেইশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, বাবা সরকারি চাকরি করেন, সংসার চলে টানাটানিতে। রিয়াদ শান্ত স্বভাবের, সবসময় হাতে একটা বই থাকে। একদিন বইয়ের ভেতর থেকে চোখ তুলে সে হঠাৎ দেখল—এক মেয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। লাল ওড়নায় ঢাকা মুখ, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি। মেয়েটির নাম মায়া। মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ভিড়ের মাঝেই একবারের জন্য চোখাচোখি—এটাই তাদের প্রথম দেখা। কোনো কথা হয়নি, তবুও দু’জনের চোখে একরকম ঝিলিক খেলে গেল। পরিচয়ের শুরু দিন গড়াতে থাকে। রিয়াদ সেই সময়টায় প্রায়ই ফার্মগেটে দাঁড়ায়, শুধু মায়ার দেখা পাওয়ার আশায়। ভাগ্য যেন সহায় হলো—একদিন বৃষ্টির দিনে বাসস্ট্যান্ডে তারা পাশাপাশি দাঁড়াল। দু’জনেই ভিজে যাচ্ছিল, হঠাৎ রিয়াদ ছাতা বাড়িয়ে দিল। মায়া হাসল, সেই হাসিতে রিয়াদের বুক কেঁপে উঠল। মায়া বলল, “আপনার বইয়ের ভেতরে এত ডুবে থাকেন, বাইরের পৃথিবী দেখতে পান তো?” রিয়াদ একটু লাজুক গলায় উত্তর দিল, “পৃথিবী তো আজকেই প্রথম চোখে পড়ল।” সেদিন থেকেই কথার সূত্রপাত। কফিশপে একসাথে বসা, বইমেলায় বই ঘাঁটা, মেডিকেল কলেজের রাস্তায় হাঁটা—শহরের বিশৃঙ্খলার মাঝেই জন্ম নিল এক নিঃশব্দ প্রেম। প্রেমের স্বপ্ন রিয়াদ আর মায়া দু’জনেই স্বপ্নবাজ। রিয়াদ লেখক হতে চায়, কবিতা লিখে। মায়ার স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাদের আলাপচারিতা যেন শহরের কোলাহলের ভেতর এক শান্ত নির্জনতা। মায়া একদিন বলল, “তুমি লেখক হবে, তোমার বই একদিন আমি হাসপাতালের ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে পড়ব।” রিয়াদ চোখ নামিয়ে উত্তর দিল, “তুমি থাকলেই লিখব, তোমাকে নিয়েই লিখব।” তাদের প্রেম ছিল না কোনো জাঁকজমকপূর্ণ রঙে রাঙানো, বরং ছিল খুবই সহজ—এক কাপ চা, শহরের ব্যস্ত গলি, আর হৃদয়ের নিঃশব্দ বোঝাপড়া। সমাজের বাধা কিন্তু শহরের ভালোবাসা সহজ নয়। মায়ার পরিবার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী পরিবার। তাদের চোখে মেয়ের বিয়ে মানে পারিবারিক মর্যাদা ও সম্পদের জোট। আর রিয়াদ—একজন সাধারণ চাকরিজীবীর ছেলে, যে এখনও পড়াশোনা শেষ করেনি। একদিন মায়ার বাবা সরাসরি বলে দিলেন, “আমার মেয়ের বিয়ে হবে বিদেশফেরত ব্যবসায়ীর সাথে। ভালোবাসা দিয়ে সংসার চলে না, সম্মান লাগে।” মায়ার বুক ভেঙে গেল। সে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু লাভ হলো না। সমাজের শেকল তাদের ভালোবাসাকে ঘিরে ধরল। মায়া কেঁদে রিয়াদের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “আমি কাউকে ছাড়া থাকতে পারব না।” রিয়াদ কষ্ট চেপে বলল, “তুমি যদি সুখ পাও, আমি চুপচাপ হারিয়েও যাবো।” বিচ্ছেদের দিন মায়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল বিদেশফেরত এক ব্যবসায়ীর সাথে। বিয়ের আগের রাতে রিয়াদ শহরের ধোঁয়াটে আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে লিখছিল কবিতা। তার শব্দগুলো ভিজে যাচ্ছিল অশ্রুতে। বিয়ের দিন ঢাকার এক অভিজাত কমিউনিটি সেন্টার আলোয় ঝলমল করছিল। আতশবাজি, গান, সাজসজ্জা—সবই ছিল, শুধু রিয়াদের ভেতরের অন্ধকার ছাড়া। সে দূর থেকে দেখল, মায়া লাল বেনারশিতে সেজে বসে আছে, চোখ ভরা জল। কেউ দেখেনি, কিন্তু রিয়াদ জানত—সেই অশ্রু তার জন্যই। নতুন জীবন, পুরনো স্মৃতি বছর কয়েক কেটে গেল। রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে সাংবাদিক হলো। কলাম লিখতে শুরু করল—প্রেম, বিচ্ছেদ আর শহরের কষ্ট নিয়ে। তার লেখায় অদ্ভুত মায়া ছিল। পাঠকেরা জানত না, প্রতিটি লেখার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক মায়ার নাম। অন্যদিকে মায়া নতুন জীবনে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করল। বিয়ের পর স্বামী বিদেশে থাকে, মাঝে মাঝে আসে। তার জীবনে অভাব নেই, আছে গাড়ি-বাড়ি-সম্মান। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অদৃশ্য শূন্যতা গ্রাস করে রেখেছে তাকে। রাতে শিশুকে ঘুম পাড়ানোর পর জানালার বাইরে তাকিয়ে সে শুধু ভাবে—যদি অন্যরকম হতো! ৭. হঠাৎ দেখা এক শীতের সন্ধ্যায় বইমেলায় রিয়াদের নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হলো। ভিড়ের মধ্যে সে হঠাৎ দেখল—নীল শাড়ি পরা এক নারী, কোলের ছোট্ট শিশুকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া। দু’জনের চোখ আবার মিলল। অনুষ্ঠান শেষে বাইরে তারা কিছুক্ষণ দাঁড়াল। মায়া বলল, “তুমি বদলাওনি রিয়াদ। তোমার চোখে এখনও সেই আগুন।” রিয়াদ হেসে উত্তর দিল, “আর তুমি এখনও আমার প্রেরণা। শুধু আমাদের গল্পটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।” তাদের চোখে অশ্রু জমল, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। ভিড়ের শহরে দু’জন আবার আলাদা পথে হাঁটল। অপূর্ণতার আলো বছর আরও পেরিয়ে গেল। রিয়াদ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠল। তার প্রতিটি বই প্রেম আর বিচ্ছেদের গল্পে ভরা। পাঠকেরা তাকে “অপূর্ণতার কবি” বলে ডাকতে লাগল। মায়া তার সন্তানের মানুষ গড়ার কাজে ব্যস্ত হলো। বাইরে থেকে তার জীবন পরিপূর্ণ, ভেতরে শুধু এক অদৃশ্য হাহাকার। কখনো রাতে জানালার আলোতে বসে মায়া রিয়াদের বই খুলে পড়ে। প্রতিটি লাইনে সে খুঁজে পায় নিজেকে। মনে হয়, বইয়ের ভেতর দিয়ে যেন রিয়াদ এখনও তার হাত ধরে আছে। শেষ দেখা এক বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে এক সাহিত্য আসরে রিয়াদের বক্তৃতা ছিল। মায়া গোপনে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াল। রিয়াদ বলছিল, “ভালোবাসা সবসময় পাওয়া নয়। ভালোবাসা কখনো কখনো মানে শুধু মনে রাখা।” মায়ার চোখ ভিজে উঠল। বক্তৃতা শেষে রিয়াদ ভিড়ের ভেতর মায়াকে খুঁজল না, কিন্তু মনে মনে জানত—সে এসেছে। তারা শেষবারের মতো একে অপরকে দূর থেকে দেখল, তারপর শহরের ভিড়ে মিলিয়ে গেল। ঢাকা শহরের জানালাগুলো একে একে আলোয় ভরে উঠল। কোনো জানালার আলোয় মায়ার মুখ, কোনো গলির অন্ধকারে রিয়াদের নিঃশব্দ হাঁটা। তারা একে অপরের থেকে দূরে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একই আলোতে জ্বলছে। কারণ ভালোবাসা শহরের ধুলোয় মিশে গেলেও শেষ হয়ে যায় না। ভালোবাসা কখনো কখনো অপূর্ণতার ভেতরেই বেঁচে থাকে—নগরের জানালার আলো হয়ে।

এই প্রতিবেদনটির তথ্য, বক্তব্য ও সকল দায়-দায়িত্ব লেখকের। এর জন্য সম্পাদক দায়ী থাকবেনা