আদিবাসী অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী সমাধান

এফএনএস | প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর, ২০২৫, ০৫:১২ এএম
আদিবাসী অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী সমাধান

বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের ইতিহাসে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার প্রশ্নটি দীর্ঘদিন ধরেই উপেক্ষিত। পাকিস্তান আমলে শুরু হওয়া বৈষম্য ও বঞ্চনার যে ধারাবাহিকতা, তা স্বাধীনতার পরও থামেনি-এ কথাই উঠে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের আয়োজিত সাম্প্রতিক আলোচনায়। বক্তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট, সমস্যা শুধু নীতি বা সদিচ্ছার অভাব নয়; বরং মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারহীনতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ঘাটতির একটি গভীর সংকট। পার্বত্য চট্টগ্রাম বহু জাতিগোষ্ঠীর আবাসস্থল। তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য ১৯৯৭ সালে করা চুক্তি ছিল ঐতিহাসিক। কিন্তু চুক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ আজও বাস্তবায়িত হয়নি। শামসুল হুদার বক্তব্যে যে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের আহ্বান এসেছে, তা পার্বত্য অঞ্চলে বিগত পাঁচ দশকে সংগঠিত হত্যা, ভূমি দখল ও সাম্প্রদায়িক হামলার দায় নিরূপণে প্রয়োজনীয় মনে হয়। সত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি শান্তি স্থাপন সম্ভব নয়। অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরীর তথ্য আরও উদ্বেগজনক-মাত্র দুই দশকে এক লাখের বেশি মানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং পরবর্তী ২৭ বছরে বিচারহীনতার দীর্ঘ ছায়া। এই কাঠামোগত সংকট দূর করতে শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যথেষ্ট নয়; আইনি, প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য। একই কথা বলেছেন সোহরাব হাসান-রাষ্ট্র যদি দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকত, তবে আলাদা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হতো না। অধিকার প্রশ্নে ভাষা ও পরিচয়ের সঠিক স্বীকৃতিও গুরুত্বপূর্ণ। শিরীন হকের মতে, জনগোষ্ঠীর ওপর ‘সংখ্যালঘু’ পরিচয় চাপিয়ে দেওয়া তাদের মর্যাদাকে খাটো করে। নতুন প্রস্তাবিত জুলাই সনদে বাংলাদেশকে বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং রাষ্ট্রের নাগরিক কাঠামোকে বিস্তৃত করার পথে এক অগ্রগতি। তবে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে গভীরভাবে আলোচনায় এসেছে তা হলো-পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনে সফল একটি বাহিনী দেশের ভেতর একই সফলতা দেখাতে কেন পারছে না-ইফতেখারুজ্জামানের এই প্রশ্নটি মনোযোগ দাবি করে। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের অংশ, বিচ্ছিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। তাই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা অপরিহার্য, তবে তা অবশ্যই নাগরিক জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ ছাড়া হতে হবে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রত্যাশা ছিল, তাতে আদিবাসী অধিকার ও চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকাটা হতাশাজনক। স্থায়ী শান্তি, উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় সমতা নিশ্চিত করতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আর উপেক্ষা করা যাবে না। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং আদিবাসীদের মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতিই পারে পাহাড়ে সত্যিকারের শান্তির ভিত্তি রচনা করতে।