রাষ্ট্রও মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়। নাগরিকদের ন্যায্য প্রাপ্য সংগ্রাম করে আদায় করতে হয় কেন? অধিকার যদি আটকে থাকে তবে কল্যাণ দূরবর্তী হয়। রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। নাগরিকদের থেকে দায়িত্ব-কর্তব্য ঠিকমতো আদায় করতে হলে রাষ্ট্রকেও তো ঋণ শোধ করতে হবে। সেবার বিনিময়ে কেবল অর্থ নয়, বরং সম্মানও জড়িত। যখন রাষ্ট্রকে জিম্মি করে সম্মান ও অধিকার আদায় করতে হয়, তখন সেটা আন্দোলনকারীদের জন্য যেমন শোভনীয় নয়, তেমনি রাষ্ট্রের জন্যও সম্মানের নয়। বিব্রতকর পরিস্থিতি উদ্রেকের ক্ষেত্রে কার্যকারণ-সম্পর্ক উপেক্ষা করার সাধ্য নেই। বরং রীতিনীতি মেনে যার যার পাওনা সময়মতো আদায় করলেই ল্যাঠা চুকে যায়।
নাগরিকদের যেমন রাষ্ট্রের সক্ষমতা বিবেচনা করতে হবে, রাষ্ট্রকেও তেমনি নাগরিকদের মনের চাওয়া বুঝতে হবে। সবকিছু যদি এক নিয়মে চলত তবে আর দুঃখ থাকত না। বিশৃঙ্খলাও একমুখী হলে সেটাই শৃঙ্খলা। কিন্তু কেউ যথাসময়ে, যথা নিয়মে পাচ্ছে এবং কেউ বঞ্চিত হচ্ছে, আদায় করতে আন্দোলনে বাধ্য হচ্ছে-এসব বিশৃঙ্খলাকে উসকে দিচ্ছে। কর্মবিরতি দিয়ে, রাজপথ অবরোধ করে কিংবা ধর্মঘট দিয়ে জনভোগান্তি বাড়ে। অথচ রাষ্ট্রের কাছে সুষ্ঠু সমাধানের অপশন সবসময়ই থাকে। সবকিছু নিয়মতান্ত্রিক হলে কোনো বিরহবেদনার উদ্রেক হয় না। কাগজের নিয়ম যদি বাস্তবায়নে ব্যত্যয় ঘটে, তবে বিপর্যয় অনিবার্য। রাষ্ট্র এই হেলাফেলা সহ্য করবে কেন? সেবাগ্রহীতারা সেবা বঞ্চিত হয়ে ধকল পোহাবে কেন? দায় কি একপাক্ষিক?
কর্মজীবন মানেই ভালো থাকার নিশ্চয়তা নিশ্চিতকরণ। সেখানে বিশৃঙ্খলা থাকলে কর্মপরিবেশ নষ্ট হয়। তখন সমাজে কষ্টটা বিস্তৃত হয়। সঠিক সময়ে পদোন্নতি, নিয়মতান্ত্রিক পদায়ন এবং সম্মানজনক বেতনের বাস্তবায়ন স্বয়ংক্রিয় না হলেও এসব সক্রিয়ভাবে করার কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই আছে। বঞ্চিত হয়ে সেবাদাতা সঠিক সেবা প্রদান করতে পারবে? মানুষের মন তো আর যন্ত্র নয়। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হলে সেটার প্রভাব ব্যক্তিজীবন, সংসার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের সর্বত্রই আংশিকভাবে বণ্টিত হয়। কর্মের উদ্যমতা হারিয়ে গেলে আদর্শ সেবা নিশ্চিত করা যায় না। একবার মন ভাঙলে তা পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে জীবন-যৌবন ফুরিয়েও যেতে পারে। রাষ্ট্রকে সবার ক্ষেত্রেই ন্যায্যতা বজায় রাখতে হবে। নয়তো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য স্পর্শ করা কঠিন হবে।
কল্যাণ রাষ্ট্রের ধর্মই হচ্ছে ন্যায়পরায়ণতা। নাগরিককে সে সমমর্যাদা দেবে এবং বৈষম্য শূন্যে আনতে চেষ্টা করবে। বাংলাদেশও কল্যাণ রাষ্ট্র হোক- সামগ্রিক প্রত্যাশা। সেজন্য যেগুলো প্রতিবন্ধকতা, তা উচ্ছেদে অংশীজনদের অংশগ্রহণ লাগবে। পেশাজীবীগণ সম্মানিত হোক, নাগরিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাক কাঙ্ক্ষিত সেবা। ন্যায্য কিছু পেতে যাতে কাউকে আন্দোলন করতে না হয়। জিম্মি করে আদায়ের প্রবণতা চরমভাবে ঘৃণিত হোক-এই মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে সবার আগে প্রয়োজন ন্যায়বোধের শিক্ষা।
চোখের সামনে অন্যায় সংগঠিত হতে দেখে, স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতি চলতে দেখে ন্যায়পরায়ণতা পালন করা মুশকিল। রাষ্ট্র যাদের চোখ দিয়ে সবকিছু অবলোকন করে, সেই চোখগুলো অবশ্যই লোভ-ক্ষোভহীন, মোহ এবং ক্রোধহীন থাকতে হবে। তারা কিছু ভোগ করার আগে যাতে জনগণের কাছে সেটা পৌঁছায়। সেজন্য রাজনীতিতে শুদ্ধতা সবার আগে জরুরি।
এদেশে জনসংখ্যা অনেক, ভোটারও কম নয়; কিন্তু সুনাগরিক গড়ে তোলার প্রকল্প কোথাও আটকে আছে। মানুষকে তো মানুষ করে তুলতে হবে। আমাদের আর কিছুরই অভাব নেই; ভালো মানুষ ছাড়া। বড়ো বড়ো কবি-সাহিত্যিক আছেন, সুপরিচিত পণ্ডিতগণ আছেন, নামকরা নেতা-নেত্রী চারদিকে, আলোচক-সমালোচক, অভিনেতা-অভিনেত্রী কিংবা ধনকুবের-শিল্পপতি-এখানে কোনোকিছুরই কমতি নেই।
অভাব অনুভূত হচ্ছে বাতিঘরের। দু-একটি আলো টিমটিম করে যা জ্বলছে তা ‘দশচক্র ভগবানের ভূত’ হওয়ার দশায়। খারাপির চোটপাট এত অধিক যে ভালো খড়কুটোর মতো এ-ঘাটে ও-ঘাটে ঘুরছে। ঠাঁই করতে পারছে না কোথাও। এই দশা থেকে উত্তরণ সম্ভব না হলে আমাদের মুক্তি অসম্ভব। জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি। নইলে জাতি দিশা হারাবে।
লেখক: রাজু আহমেদ; কলাম লেখক