দেশজুড়ে শুক্রবার ও শনিবার কয়েক দফায় ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে সোমবার, ২৪ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় জানানো হয়, সাম্প্রতিক কম্পন নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, তবে সতর্কতামূলক সব ধরনের প্রস্তুতি জরুরি। সরকারও প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত আছে।
সভায় বিশেষজ্ঞরা জানান, ভূমিকম্পের প্রকৃতি ও মাত্রা বিবেচনায় বাংলাদেশ স্বল্প ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। তাই বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা কম। তবে সঠিক প্রস্তুতি না থাকলে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার ঝুঁকি থাকে। তারা বলেন, ভূমিকম্প কখন ঘটবে কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। অতীতের রেকর্ড দেখে একটি সম্ভাব্য সময়সীমা বোঝা যায়, কিন্তু নির্দিষ্ট দিন বা সময় ঘোষণা করা বিভ্রান্তিকর এবং বৈজ্ঞানিক নয়।
জরুরি সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বিশেষজ্ঞদের উদ্দেশে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অবস্থাতেই হাত গুটিয়ে রাখা হবে না। আবার অবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপও নেওয়া হবে না। তিনি অনুরোধ জানান, অল্প সময়ের মধ্যে লিখিত আকারে পরামর্শ দিলে সরকার সেগুলো পর্যালোচনা করে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। তিনি জানান, বিশেষজ্ঞ কমিটি ও এক বা একাধিক টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।
সভায় প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, “ভয়াবহ ভূমিকম্পে যাদের জীবন গেছে, যারা আহত হয়েছেন, এটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে না ঘটে, তার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। জনগণের আতঙ্ক দূর করা এবং সচেতনতা বাড়ানো এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি বিদেশে থাকা বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের সঙ্গেও সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এবং জানান যে ‘শুভেচ্ছা’ অ্যাপের মাধ্যমে তাদের যুক্ত করা সম্ভব হবে।
সভায় উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা ভূমিকম্পের নানা দিক নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, দেশের আশেপাশের ভূমিকম্প উৎসগুলো চিহ্নিত করে সম্ভাব্য কম্পনের মাত্রা নিরূপণ করতে হবে। তিনি জানান, বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা কম হলেও প্রস্তুতি অবহেলা করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আখতার বলেন, জনসচেতনতা তৈরিতে তরুণদের যুক্ত করতে হবে। তিনি ইনডোর ও আউটডোর উভয় পরিবেশে চার স্তরে করণীয় পরিকল্পনা তৈরি করে তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মন্ত্রণালয়গুলোর অধীনস্থ স্থাপনাগুলোর কাঠামোগত মূল্যায়ন জরুরি। বিশেষ করে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গ্যাস–বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে অবকাঠামোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্কুল–কলেজে নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া চালু করা হলে আতঙ্ক কমে, সচেতনতা বাড়ে।
এমআইএসটির অধ্যাপক মো. জয়নুল আবেদীন বলেন, মানুষকে আতঙ্ক থেকে দূরে রাখতে হবে এবং করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বার্তা পৌঁছাতে হবে। তিনি বলেন, খোলা জায়গা কোথায়, কোথায় আশ্রয় নেওয়া যাবে, এসব তথ্য সবাইকে জানাতে হবে এবং নিয়মিত মহড়া চালু রাখতে হবে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. খালেকুজ্জামান চৌধুরী জানান, সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দুই শটির বেশি ভবনের প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষতি পার্টিশন দেয়ালে। প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত ভবন মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হচ্ছে।
সভায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, দুর্যোগ ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, গৃহায়ন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আলী রিয়াজ উপস্থিত ছিলেন। বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, আবহাওয়া অধিদপ্তর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ গবেষকরা।
সভা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, বিশেষজ্ঞদের লিখিত সুপারিশ হাতে পেলেই সরকার দ্রুত সময়ে টাস্কফোর্স গঠন করবে। ভূমিকম্প প্রস্তুতি, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং জরুরি ব্যবস্থাপনা নিয়ে টাস্কফোর্স কার্যকর উদ্যোগ নেবে।