ক্ষমতা ও সুবিধার জন্য যারা অন্যের ক্ষতি করে কিংবা কাউকে অসম্মান, অপমান-অপদস্থ করে- এর হিসাব এমনি এমনি যায় না; মোটেই না। দুনিয়াতেই অনেক হিসাবনিকাশ বরাবর হয়ে থাকে। অন্যায়ভাবে কেউ কাউকে ঠকালে কিংবা সামান্যও ব্যথা দিলে তার জন্যও ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্র তৈরি হয়। ইতিহাস বলে, ডিভাইন পানিশমেন্ট অবশ্যম্ভাবী- এটা ঘটবেই।
কেউ কারো ক্ষতি করেছে এবং শান্তিতে থেকেছে- এ দৃশ্য বিরল। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক কিছুই দেখতে পারে না কিন্তু ক্ষতিকর যে ব্যক্তি, তার ক্ষত অন্তর পর্যন্ত গভীর হয়। স্বস্তি কেড়ে নিয়ে তাকে চরম অস্বস্তির দিকে ঠেলে দেয়; তবেই যেন প্রকৃতির প্রতিশোধ শান্ত হয়। মানুষ মুখোশ দেখে ভাবে সব সুখ সেখানে অথচ অন্তরের অসুখের আগুনে দাউ দাউ করে পোড়ানোই ক্ষতিকারীর নিয়তি হয়ে ওঠে।
ক্ষতিগ্রস্ত চায়- যিনি ক্ষতি করেছে তার বিচার এখনই আর এখানেই হোক। যে ব্যথা সে পেয়েছে, যে স্বপ্ন ভেঙেছে, যে সময় জুড়ে ভুগেছে- সবকিছুর প্রতিফলনে অপরজনও যেন বুক চাপড়ে কাতরায়। অথচ প্রকৃতির প্রতিশোধ সম্পূর্ণ অন্যরকম। চোখের পানির ক্ষতিপূরণ সে একবারে আদায় করে না-বরং আজীবন ভোগায়।
যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি, যে বিশ্বাস ভেঙেছে- তার অন্তর থেকে চিরতরে প্রশান্তি তুলে নেওয়া হয়। বাইরে থেকে মানুষ দেখালেও ভিতরের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। ভালো না লাগার রোগে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলা হয় যেন কোথাও আর স্বস্তি খুঁজে না পায়। মুক্তির জন্য মৃত্যু খোঁজে, কিন্তু মৃত্যু যেন তাকে স্মরণ করে না। বরং জাগতিক কষ্ট ও প্রবঞ্চনা তাকে ঘিরে ধরে।
যে ব্যক্তি কারো বিশ্বাস ভেঙেছে, ক্ষমতার দাপটে দুর্বলকে আঘাত করেছে, অন্যায়ভাবে কারো সম্মানহানি করেছে- প্রকৃতির প্রতিশোধের চক্রে একবার পতিত হলে তার দিকে প্রকৃতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। ক্ষতিগ্রস্তের মনোবেদনা যত ভারী হয় তার চেয়েও শতগুণ দহন ক্ষতিকারককে পোড়ায়- দুনিয়াতেই, চোখের সামনে।
অসম্মান, ক্ষমতা হারানো, দুর্যোগ বা দুর্ভোগে পতিত হওয়া- এসব কেবল পরীক্ষা নয়; অনেকটাই অতীতের কর্মফল। মানুষ অতীতে যা রেখে যায়, তার প্রতিদান ভবিষ্যতে পাবেই। সুযোগ পেলেই যারা অন্যের ক্ষতি করে, অযাচিত ষড়যন্ত্রে মাতে, ডেভিলের সঙ্গে সন্ধি পাতে, শয়তানের পথে হাঁটে- তাদের মুক্তি এত সহজ নয়। সব দায়-দেনা শোধ করিয়েই প্রকৃতি শান্ত হয়।
ক্ষমতায় থেকেও ক্ষমতাহীন থাকা, নিজেকে বিনয়ের শৃঙ্খলে রাখা এবং সৎসঙ্গে হাঁটা, সৎপথে বাঁচা- মানবজীবনের সেরা অলংকার। কারো ক্ষতি না করে বাঁচার মধ্যেই পরম আনন্দ। অন্যের উপকারে আসতে পারা, কারো দোয়া ও ভালোবাসায় বাঁচা- এসব মানবজীবনের সৌভাগ্য।
কেউ ব্যথা দিক- চুপ থাকুন। কেউ কথা শোনাক- চুপ থাকুন। কেউ ক্ষতি করুক- চুপ থাকুন। এসবের বিপরীতে আপনার প্রতিক্রিয়া হয়ত যথেষ্ট নয়, কিন্তু যিনি দো-জাহানের মালিক, তিনি আপনার হয়ে সব অপবাদ, চক্রান্ত ও ক্ষতির মোকাবিলা করবেন। আপনি শুধু সময়ের অপেক্ষা করুন। তবে আপনার কথা ও কাজ যেন কাউকে সামান্যও ক্ষতিগ্রস্ত না করে। বিনা প্রয়োজনে একটি পিঁপড়ের স্বাভাবিক জীবনযাপনকেও বাধাগ্রস্ত করা অনুচিত।
স্রষ্টাকে সময় দিন, আস্থা রাখুন। তিনি সৃষ্টির প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল। কেউ আপনাকে আঘাত করুক, বেদনা দিক, ঠকাক- তিনি নির্বিকার নন। যিনি ন্যায়বিচারের প্রতীক, তিনি আপনার ক্ষেত্রেও ন্যায্যতার সমতা প্রতিষ্ঠা করবেন। আপনার ধৈর্যই তাঁর কাছে আপনার সফলতার মাপকাঠি। ত্বরিত প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সময় নিন।
দেখবেন, যে বিচার আপনি কামনা করেছিলেন তার চেয়েও সঠিক বিচার হয়েছে। যে আপনাকে হুল ফুটিয়েছে- প্রকৃতি তার সেই হুলই তুলে নিতে পারে। শত্রুকে পরিণত করতে পারে দাসে। কখনই আশাহত হবেন না। কনকনে শীতের শেষেই আসে বসন্ত; গভীর অন্ধকার ভেদ করেই আসে ভোরের আলো। তাই শান্তির নিশ্চয়তা, বুঝে পাওয়া এবং চাওয়া পূরণের জন্য ধৈর্যই একমাত্র পথ।
সবকিছু আপনি নাও দেখতে পারেন, নাও জানতে পারেন- কিন্তু বিপ্লব ঘটে যাবে নীরবে। যে যতখানি ঋণ তৈরি করবে, তাকে দিয়েই তা শোধ করানো হবে। ক্ষতিপূরণ দিতেই হবে- ক্ষতের সৃষ্টিকারীকেই। বিশ্বাস রাখুন- কোনো কিছুই এমনি এমনি যায় না। দুনিয়াতেই সব আবর্তিত হয়; সব পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়না বটে, তবে অবশ্যম্ভাবীভাবে ঘটে।
লেখক: রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক